শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৯:১২
ব্রেকিং নিউজ

মুুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা

মুুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা

আমির হোসেন আমু
 
১ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ ঘোষণার সাথে সাথে ঢাকাসহ সারাদেশে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল। শুরু হলো পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানোÑ স্লোগান উঠল- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব’ ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারাদেশে দীর্ঘদিনের কার্যক্রমেরই বহিঃপ্রকাশ।
৭ মার্চের ভাষণের পরে আমরা বৃহত্তর বরিশালে ৮ মার্চ পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি। সর্বজনাব আবদুল মালেক খান, নুরুল ইসলাম মঞ্জু, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, মহিউদ্দিন আহম্মদ এবং আমির হোসেন আমু। সর্বত্র বিকালে জনসভাÑ সন্ধ্যায় গণসংগীতের আসর, পাশাপাশি ছাত্র-যুবকদের ট্রেনিং শুরু করালাম। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে খালেদ মাহমুদ আলী (ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক) এবং ফজলুর রহমান রাজু (ধানমন্ডি আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিল) ফোনে জানাল আর্মি ক্রাকডাউন করছে; ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছে। বঙ্গবন্ধু অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, আপনারা যুদ্ধের জন্য তৈরি হন।
 
আমরা কয়েকজন বসে আলোচনা করছি, কীভাবে কি করব- তখন বরিশালের থানা থেকে সিআই-ওসি চাঁনমিয়া সাহেব জানালেন ঢাকাতে আর্মি রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার, বিডিআর হেডকোয়ার্টার পিলখানাসহ বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল আক্রমণ করেছে, আর বসে থাকা যায় না, আমরা ৩৫ জন থানার অস্ত্রসহ আপনাদের সাথে আছি। এসপির কাছে গিয়ে তাকে এসে শরিক হতে বলেন এবং পুলিশ লাইনে গিয়ে আপনারা তাদের আহ্বান জানান। তখন আমি জেলার সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম মঞ্জু, মহিউদ্দিন আহম্মদ এসপির বাসার ভিতরে ডাকাডাকি করার পর উনি উপরে বারান্দায় এলেন। আমরা উনাকে মালখানার চাবি নিয়ে আসতে বললাম, উনি (এসপি) এক ঘণ্টার সময় নিলেন। আমরা ওখান থেকে এসে পুলিশ লাইনে পুলিশদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিলাম; তারা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগান দিয়ে আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করল। তখন আরআই বলল, এসপি সাহেব চাবি না দিলেও অসুবিধা নাই, আমার কাছে ডুপ্লিকেট আছে। আমি মালখানা খুলে দেব। ওখান থেকে বেরিয়ে এসপির বাসায় গেলাম, উনি কোনো কথা না বলেই চাবি দিয়ে দিলেন। আমরা রাতের বেলাই অস্ত্র বের করা শুরু করলাম। পরের দিন সকালে পেশকার বাড়ির পুকুরে ওজু করে আমার হাতে রাখা কোরআন শরিফে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করে অস্ত্র নিল সবাই। আমরা ইতোমধ্যে সদর গার্লস স্কুলে আমাদের যুদ্ধকালীন কন্ট্রোল রুম বানালাম, অফিস বানালাম, আমরা প্রশাসন টেকওভার করলাম। জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুকে সিভিল চিফ এবং আমাকে ত্রাণ বিষয়ক দপ্তর দেওয়া হয়েছিল। মোট ১৪ সদস্য বিশিষ্ট ছিল।
 
আমি ছিলাম রিলিফের দায়িত্বে। যদিও যারা ট্রেনিং নিছে সবাই আমার বিভিন্ন সময়ের ছাত্রলীগের কর্মী, তাদের লয়ালিটি তাদের কমান্ডিং অফিসারের চেয়ে আমার প্রতি বেশি। তাই মাঝে মাঝে ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়ে ছেলেদের ডিসিপ্লিনের ব্যাপারটা ভালো করে বুঝিয়ে আসতাম।
 
আমরা যখন এসব কাজ নিয়ে ব্যস্ত, তখন টেলিগ্রাম অফিস থেকে ওখানকার কর্মচারী এসে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা আমাদের কাছে দিল। ততক্ষণাৎ আমরা মাইকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার শুরু করলাম।
 
আমরা শহরের চতুর্দিকে ৪টি অস্ত্র রাখার ডাম্প করে অস্ত্র রেখেছিলাম। খুলনায় যুদ্ধ চলাকালীন আমরা নিয়মিত বরিশাল থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদসহ, চিড়া, মুড়ি, গুড়, ডাব বিভিন্ন সহযোগিতা তাদের জন্য পাঠাতাম। ১৮ মার্চ বরিশালে প্রথম এয়ার স্ট্রাইকিং হয়। তখন আমরা উইথড্রল-এর জন্য কয়েকটি রাস্তা ঠিক করি।
 
২৬ এপ্রিল ওরা গানবোটের মাধ্যমে আক্রমণ করে। গানবোটের মর্টার সম্পর্কে কোনো আইডিয়া ছিল না। দেখলাম যে অঞ্চলে লাগে সেই এলাকা পুড়ে যায়। আমি গাড়ি নিয়ে কালিজিরা গিয়ে এসপির লঞ্চে উঠলাম। এর মধ্যে ওখানে এয়ার শেলিং হলো। লোকজন গাছপালা দিয়ে আমার লঞ্চ ঢেকে দিল। গাছপালা দিয়ে সাজানোর পর লঞ্চ ছাড়ি। রাতে ঝালকাঠী পৌঁছি। আক্কাস, সঞ্জীব, মোস্তফাসহ কয়েকজন দেখা করতে এলো। আমি তাদের হাতে ৩০-৩৫টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও কয়েক বাক্স গুলিসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে লঞ্চ ছাড়লাম। সকালে শেখেরহাটে গানবোট এসে লঞ্চ থামাতে বলে চলে গেল। এখানে নেমে বাড়ি হয়ে পিরোজপুরে গেলাম; ওখান থেকে পাড়েরহাটে যাওয়ার পথে প্রচ- গোলাগুলির মধ্যে কোনোরকম গিয়ে একটি নৌকায় উঠলাম, আউয়াল সাথে থেকে ঠিক করে দিয়েছিল। ওখান থেকে বানাড়িপাড়া-স্বরূপকাঠী-নাজিরপুর হয়ে বাগেরহাট, বরিশালের এক ওসি ছিলেন (মোশারফ সাহেব) তার বাসায় দুপুরে খেলাম। তিনি ও তার ভাগ্নে মিন্টু আমাদের বর্ডার ক্রস করার জন্য হেদায়েতকে দিলেন। অনেক ভয়ভীতির মধ্যে মিলিশিয়াদের সামনে রূপসা পার হলাম। 
 
কয়েকদিন আগে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট পুড়িয়ে দিয়েছিল, সেই পোড়া ঘরের মধ্যে রাত কাটালাম। সকালে এক দোকানে নাস্তা করতে গেলাম। ওখানের এক লোক আমাদের তার বাড়িতে নিয়ে গেল (একটা কলোনির মতো)। কিছুক্ষণ পরেই ঐখানে মিলিশিয়া ঢুকল। আমরা পাশের দেয়াল টপকিয়ে চলে গেলাম, তাকে আর বলাও হলো না। লঞ্চঘাটে গিয়ে শুনলাম বেশ কয়েকদিন আগে একটি লঞ্চে মুক্তিবাহিনীরা অ্যারেস্ট হয়েছে (ঐ লঞ্চে বরিশালের মহিউদ্দিন এমপি সাহেবও অ্যারেস্ট হয়েছিল)। এই কদিন বন্ধ ছিল, আজকে লঞ্চ ছাড়ছে। আল্লাহর নাম নিয়ে লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ থেকে নেমে হেদায়েতের পিছনে হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় গিয়ে একটি বড় নৌকার ভিতরে আমাদের উঠাল। বলল আপনারা বিশ্রাম নেন, আমি খাবার আনছি। নৌকায় বসে বাইরে মানুষের মেয়েছেলের কান্নাকাটি শুনে উঁকি দিয়ে দেখি- শত শত শরণার্থীরা যাচ্ছে, তাদের কাপড়-চোপড় খুলে যা পাচ্ছে সব নিয়ে নিচ্ছে। বুঝলাম ও আমাদের সাথে বিটট্রে করেছে। কিছুক্ষণ পরেই ২০-২৫ জন আমাদের নিয়ে চতুর্দিকে মাটির দেয়াল-কাঠের একটি মজবুত দরজার বদ্ধ ঘরে ঢুকিয়ে সার্চ করে আমার এমপির কার্ডসহ সবকিছু নিয়ে গেল এবং বলল, কাল সকালে সাতক্ষীরা আর্মির ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে। বাইরে দরজায় তালা দিয়ে রাখল। তখন আমরা তিনজনÑ আমি, বরিশালের আওয়ামী লীগ নেতা কালু ভাই, খগেন বাবু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ঘণ্টা দুই পর বাইরের অবস্থা বোঝার জন্য দরজা ধাক্কাতেই ওদের তিন-চারজন এলো। আমি বললাম, নামাজ পড়ব, ওজুর পানি দাও। দেখলাম বাইরে বেশ পাহারাদার আছে। সন্ধ্যার পরপর ওরা আবার খাবার নিয়ে এলো, তখন হাত-মুখ ধুতে গিয়ে দেখি ঘরের চতুর্দিকে বেশ পাহারা।
 
ঘণ্টাখানেক পর খুব জোরে মেঘ ডাকা শুরু হলো। আল্লাহকে ডাকা শুরু করলাম। মুষলধারে ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হলো। আমরা তিনজন একসাথে লাথি দিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টা করছি; এমন সময় দেখি একটি ছেলে বাহির থেকে তালা ভেঙে আমাদের বের করছে। বলল, আপনি আমার নেতা, আমি ছাত্রলীগ করি, আপনি ’৬৭ সালে কনফারেন্সে এসেছিলেনÑ আমি ছিলাম। আমার বাবা এই চাপড়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের সচিব, তাকে সামনে রেখে এখানকার লোকজন এসব করছে। ওই ছেলে কিছুদূর নিয়ে একটি নৌকা দেখল, আমাদের নৌকায় উঠিয়ে দিয়ে বলল, উনাদের বর্ডারে নিয়ে যেতে পারবে, সেখানে নিয়ে যাও। কিন্তু পথে প্রায় সব বর্ডার বন্ধ হয়ে গেছে। সকাল ৯টার দিকে আমাদের নামিয়ে বলল, এভাবে যান। পথে অনেক বাধাবিপত্তি পার হয়ে বড় একটা ঘরের সামনে গেলাম। একজন ঘর থেকে এসে তিনজনের জন্য ১,৫০০ টাকা চাইল। বললাম টাকা নেই, ৫০০ টাকা আছে। টাকা নিয়ে আমাদের ৫০ পা এগুলে দেখলাম আধা শুকনো একটি খালে নৌকা দেওয়া। ওটার ওপর দিয়ে হেঁটে গেলেই ভারত (হিঙ্গলগঞ্জ-কালিগঞ্জ বর্ডার)। ওপারে গিয়ে বেড়িবাঁধের মতো মাটির রাস্তা, হেঁটে গিয়ে বড় রাস্তায় কয়েকটি ছেলে এসে বলল, তোমরা পাকিস্তানি চর। কোথা থেকে এসেছÑ নাম কী বলে বিএসএফ ক্যাম্পে নিয়ে গেল। একজন ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। আমি বললাম আমি এমপি, পথে আটকা পড়েছিলাম, ওরা পরিচয়পত্র, টাকা-পয়সা সব রেখে দিয়েছে। তবে বরিশালের যে কোনো এমপি বা লোককে আমার নাম বললে চিনবে। আমাকে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাবেন? বললাম কলকাতার মিশনে। ওখানে স্টপেজ একটা বাসে তুলে দিল। মিশনে কেউ নেই, হঠাৎ একজন এসে বলল, আপনি আমু সাহেব। আমাদের বাড়ি বরিশাল- সে আমাকে ১নং বাবু হক্কালেনে নিয়ে গেল। আমি ড্রয়িংরুমের সোফায় ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে তার ছেলেসহ এসে তাদের বাসায় নিয়ে গেল। গোসল করে নাস্তা করার পর আমাকে প্রিন্স অব স্ট্রিট অফিসে নিয়ে এলো। একটি বড় হল রুমের লম্বা টেবিলের এক পাশে সোহরাব হোসেন সাহেব বসে আছেন। এদিকে দু-চারজন লোকÑ উনি কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে করতে শাহ মোয়াজ্জেম ভাই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। চা দিতে বলে একটি রেজিস্টারি খাতা বের করে বললেন সই দেও; এমপি হিসেবে ১৫০ টাকা সম্মানি পাবে। আমি টাকাটা নিলাম। এরপর ফণী ভূষণ মজুমদার এবং আবদুর রব সেরনিয়াবাত সাহেব এলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে সোজা এনে গাড়িতে তুলে একটি পার্কের সামনে গাড়ি থামিয়ে বললেন, এটার নাম নর্দান পার্ক। ওপারে বড় বাড়ি, যা ২১নং সানি ভিলা, ওটা তোমাদের থাকার জায়গাÑ যাও। আমি মাঠ পেরিয়ে বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দারোয়ানকে গেট খুলতে বলতেই দেখি সিরাজুল আলম খান। তিনি আমাকে ধরতে এসে থেমে গেলেন। বললেন, আমি আজকে চিকেন পক্স থেকে উঠেছি, তাই কাছে আসতে পারলাম না। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁ-দিকে রুম, খাট আছে- ওখানে গিয়ে বিশ্রাম করেন, খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি গিয়ে শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সন্ধ্যায় তোফায়েল সাহেব ডেকে তুলে নিউমার্কেটে নিয়ে গেল। আমার কাপড়-চোপড় কিনে দিয়ে মন্ত্রীদের সাথে দেখা করতে নিয়ে গেল। প্রথম সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব, মনসুর আলী সাহেব, কামারুজ্জামান সাহেব, খন্দকার মোশতাক- সবার সাথে দেখা হলো। সবাই বরিশালের অবস্থা জানতে চাইলেন। আমার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করতে বললেন। এক সিঁড়ি নেমে এসে জেনারেল ওসমানি সাহেবের সাথে দেখা করে চলে এলাম। পরের দিন ৮নং থিয়েটার রোডে গেলাম, তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা হলো।
 
একদিন পর আবার যখন মন্ত্রী সাহেবদের ওখানে গেলাম তখন মিজানুর রহমান চৌধুরী ও ওবায়দুর রহমান সাহেবের সাথে দেখা হলো। তারা বললÑ পাওয়া গেছে, আমুকেই মুক্তিবাহিনীর পলিটিক্যাল মোটিভেটর করে দেন। মনসুর ভাই অন্যদের সাথে আলাপ করে জানাবে। আমি বাসায় ফিরে এসে এ-কথা বলার পর সিরাজ সাহেব বললেন, মণি আগরতলা থেকে রাজ্জাকও আসবে। আমরা বসে আপনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবÑ তার আগে কথা দিয়েন না। আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলামÑ এটা কার বাড়িতে, কীভাবে আছি, কিছুই বললেন না। বললেন কালকের মধ্যে সব জানতে পারবেন। তখন জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর ব্যবস্থা অনুযায়ী এই বাড়ি আমাদের জন্য অর্থাৎ (মুজিব বাহিনীর) জন্য বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার রেখেছেন। উনার সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথে আমার সাথে আলাপচারিতায় সবাই অবাক। আমরা বরিশালে বাসার পাশাপাশি থাকতাম। উনি বিয়ে করেছেন, আমাদের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক দীপা দি-কে। উনি বেরিয়ে এসে আমাকে ধরে বাসার সবার নাম ধরে কে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করায় সবাই অবাক হলো।
 
পরের দিন বিকালে আমরা পাঁচজন- শেখ মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ এবং আমি আলোচনা করে ঠিক হলো- আমরা একসাথে থাকব এবং কাজ করব। এফ-সেক্টর (মুজিব বাহিনীর ৪টি সেক্টরের একটি) ৫টি জেলা- বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুর, যশোর, পটুয়াখালী। ছেলেদের রিক্রুটমেন্ট করা ট্রেনিং এবং ইনডাক্টিং করার দায়িত্ব আমার। তাদের ইনডাক্ট করা (অর্থাৎ ভিতরে পাঠাব)। সব জায়গায় আমাদের কোরিয়াররা রেকি করে ঠিক করবে কোন বর্ডার থেকে, কোন দিক দিয়ে ঢুকানো হবে। এমনকি তারা কোন বাসায় থাকবে, কোথায় কীভাবে অপারেশন করবে- সব ঠিক করে পাঠানো হতো। আমার বনগাঁয় একটি বাসা ছিল, দ্বিতীয় তলায় আমি থাকতাম এবং নিচতলায় অফিস ছিল। আমাদের ছেলেদের দুই জায়গায় ট্রেনিংয়ে পাঠানো হতো। আসামের হাফলং এবং দেরাদুনের কেন্দুয়া। ট্রেনিং নিয়ে আসার পরপর তাদের ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত থাকতে হতো। একদিন আমাদের মধ্যে বিভিন্ন আলোচনার সময় দুটি প্রস্তাবÑ একটি হলো আমাদের সবারই ট্রেনিং নেওয়া উচিত, কেননা আমরা যাদের ট্রেনিং দিচ্ছি তারা পলিটিক্যাল ছেলে হলেও ট্রেনিং নিয়ে যাচ্ছে আমর্ড ফোর্স হিসেবে। তাদের কমান্ড করতে হলে আমাদেরও ট্রেনিং থাকা উচিত। অন্যটি আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী সৃষ্টি করা উচিত। সবাই একমত হয়ে চিত্তবাবু এবং নাথবাবুকে (নাথবাবু ছিলেন আমাদের মুজিব বাহিনীর সার্বিক দায়িত্বে) জানানো হলো। উনি সাথে সাথে দিল্লি ম্যাসেজ দিলেন এবং অল্প দিনের মধ্যে প্রস্তাব পাস হয়ে এলো। আমাদের ভিভিআইপি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হলো।
 
মিসেস ইন্দিরা গান্ধী নাথবাবুর মাধ্যমেই সব ব্যবস্থা করতেন। মুজিব বাহিনীর ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন ভারতের স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের চিফ মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান। প্রথম দিকে ৭ থেকে ১১ দিনের কথা থাকলেও আমাদের ভিভিআইপি ট্রেনিং ২১ দিন হয়েছিল। আমাদের ছেলেদের চেয়ে এক ধাপ বেশি এয়ার ড্রপিং শিখিয়েছিল।
 
আমার তাঁবুতে মরহুম ইলিয়াস আহম্মদ চৌধুরী এমপি, মরহুম হাদিউজ্জামান এমপি, অ্যাডভোকেট আবদুল বারি ছিল। ভোর ৫টায় পায়ের বুড়ো আঙ্গুল টেনে ঘুম ভাঙাত এবং এক মগ চা দিত। হাফপ্যান্ট ও কেডস পরে প্যারেড-পিটি করে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে পতাকা উত্তোলন করে, গোসল করে, নাস্তা করে ক্লাসে যেতাম। ১০টার দিকে টি ব্রেক হতো, আবার দুপুর ১টা পর্যন্ত ক্লাস করে প্রাকটিক্যাল ক্লাস হতো। কীভাবে বিভিন্ন জিনিস ধ্বংস (অর্থাৎ কোনো স্থাপনা, ব্রিজ, বিমানবন্দর ইত্যাদি) আমাদের সাইফার শেখানো হয়েছিল। কী করে শত্রুদের অ্যাম্বুস করতে হয়, আবার তখন হঠাৎ বিপদ হলে উইথড্র ব্যবস্থা রাখা হয়, ইত্যাদি সব কিছু। আমাদের টিমের নির্দেশ ছিল ভিতরে ঢুকে ছেলে-মেয়েদের ট্রেনিং ব্যবস্থা এবং পলিটিক্যাল মোটিভেশন করা। ট্রেনিং থেকে ফিরে এসে বরিশালে গৌরনদী, পটুয়াখালীর বিভিন্ন জায়গার ছেলেদের কয়েকটি টিম ভিতরে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা কোরিয়ারের কথা না মানার কারণে ১১০টি ছেলে অ্যারেস্ট হয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে ছিল। ১০ ডিসেম্বর যশোর ফ্রি হওয়ার সাথে সাথে আমি যশোরে রাস করি। ওখানে তখন আর্মির দায়িত্বে ছিলেন আমার খালাতো ভাই, আগরতলা মামলার আসামি কর্নেল নজমুল হুদা। তার সহায়তায় ছেলেদের বের করে ৩ ইঞ্চি মর্টার, বিভিন্ন অটোমেটিক ওয়েপন্স, গ্রেনেডসহ তাদের বরিশাল পাঠিয়ে দিয়ে আবার কলকাতায় ফিরে এলাম।
 
আমি ১৭ মে বর্ডার ক্রস করে ভারতে ঢুকেছিলাম। আর ২০ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে রওনা হয়ে খুলনা হয়ে ২২ তারিখে বরিশাল পৌঁছলাম। যুদ্ধ চলাকালীন শুধু সময় নয়, বঙ্গবন্ধুর অবস্থান নিয়ে চিন্তা ঘুরপাক খেত। বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্ট মেম্বার, স্পিকার, কংগ্রেসম্যান, রেডক্রিসেন্টের কর্মকর্তারা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করত, তাদের জিজ্ঞেস করত দেশ স্বাধীন হলে তোমরা দেশে ফিরে যাবে কি না? তখন তারা বলত, বঙ্গবন্ধু ফিরলে যাব।
 
বঙ্গবন্ধুর প্রতি সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে চাও, না স্বাধীনতা চাও? আমরা বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা এক এবং অভিন্ন। তাই একই সাথে পেতে হবে। দেশে ফেরার সময় যেমন বিজয়ের আনন্দ খুব অনুভব করতে পারিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতির জন্য।
 
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই জাতি পেয়েছিল স্বাধীনতার স্বাদ, বুক ভরা নিঃশ্বাস, আল্লাহর পাক দরবারে শুকরিয়া আদায় করেছিলাম।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
 
লেখক : সংসদ সদস্য ও উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK