বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০০:২৩

মুক্তিযুদ্ধে যোগদান- আমার অনুপ্রেরণায় বঙ্গবন্ধু

মুক্তিযুদ্ধে যোগদান- আমার অনুপ্রেরণায় বঙ্গবন্ধু

আলমগীর সাত্তার বীরপ্রতীক 
 
ক্যাপ্টেন আলমগীর নামে আমরা দুইজন পাইলট ছিলাম, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইন্সে। ক্যাপ্টেন আবু তারেক আলমগীরকে সম্বোধন করা হতো ক্যাপ্টেন আলমগীর বলে। আমি আলমগীর সাত্তার পরিচিত ছিলাম, ক্যাপ্টেন সাত্তার বলে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ক্যাপ্টেন আলমগীর, ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দিন এবং আমি আলমগীর সাত্তার একটু বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলাম। ক্যাপ্টেন আলমগীরের বাবা ক্যাপ্টেন শাহজাহান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠজন। বঙ্গবন্ধুর লিখিত বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে পাঠক জানতে পারবেন, ১৯৪৮ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন প্রথমবার ঢাকায় আসেন, তখন ঢাকা শহরে এমন একটা ভালো হোটেল ছিল না যেখানে সোহরাওয়ার্দী সাহেব অবস্থান করতে পারেন। তেমন ভালো বাসার সংখ্যাও ছিল কম। ক্যাপ্টেন আলমগীরদের অর্থাৎ শাহজাহান সাহেবের বাসাটা ছিল খুব সুন্দর। জিন্দাবাহার লেনে প্রায় তিন বিঘা জমির ওপর দোতলা বাসাটা ছিল ক্যাপ্টেন শাহজাহানের। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল ওই বাসায়। ক্যাপ্টেন আলমগীরের বয়স ছিল তখন পাঁচ অথবা ছয়। এর অন্তত ২০ বছর পর আমরা পিআইএ-র কয়েকজন পাইলট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। ক্যাপ্টেন আলমগীর আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তাকে দেখে বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবেই চিনতে পারলেন। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর যেন এক প্রকার দৈব স্মরণশক্তি ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আসা যাক : ক্যাপ্টেন আলমগীরের অনুপ্রেরণা ছাড়া আমি এবং আমার বন্ধুদের কে কে মুক্তিযুদ্ধে যেতাম, সে-বিষয়ে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারব না। আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম ছিল না, এমন কথা আমি বলছি না। তবে সেটি আরও উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন ক্যাপ্টেন আলমগীর। বঙ্গবন্ধু তো ছিলেনই। সে-কথা আলাদাভাবে বলার প্রয়োজন নেই। আমরা তো বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত লোক ছিলাম।
১৯৬৮-এর মে মাসের ৬ তারিখ : পিআইএ-র বোয়িং প্লেনে করাচি থেকে ঢাকা আসছিলাম। প্লেনের প্রথম শ্রেণিতে যাত্রী ছিল মাত্র তিন-চারজন। করাচি এবং রাওয়ালপিন্ডিতে দু-বছর কাটিয়ে ঢাকায় ফিরছিলাম। মনে ছিল বেশ আনন্দ। আমার আসন সে সারিতে, সেই সারির অন্য প্রান্তে আমারই সমবয়সী, সুবেশধারী, সুঠাম দেহের সুদর্শনা ২৪-২৫ বছর বয়সের এক যুবক বসে ছিল। সে নিজেই আমার দিকে এগিয়ে এলো। আলাপ-পরিচয় হলো। পিআইএ-র গ্রাউন্ড ট্রেনিং স্কুলে এর আগে তাকে দেখেছি। তখন আলাপ হয়নি।
পাইলট হিসেবে ক্যাপ্টেন আলমগীর আমার চেয়ে সিনিয়র ছিল; কিন্তু বয়সের হিসাবে আমি ছিলাম বড়।
পাকিস্তানিরা বাঙালিদের সাথে কেমন দুর্ব্যবহার করছে? পূর্ব পাকিস্তানকে কতটা শোষণ করছে? সেসব প্রত্যক্ষ করার আমাদের দুজনারই সুযোগ হয়েছিল। করাচি থেকে ঢাকা পর্যন্ত সারাটা পথ পাশাপাশি বসে আমরা সেসবই আলোচনা করে কাটিয়েছি। ঢাকায় পৌঁছে বাসায় যাওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন আলমগীর এবং আমাকে একটি মাইক্রোবাস দেওয়া হলো। পুরান ঢাকার বকশী বাজারে আমাকে নামিয়ে দিয়ে আলমগীর তাদের জিন্দাবাহার লেনের বাসায় চলে গেল। বাসার দিকে রওয়ানা করার আগে আমাকে বলল, বিকালবেলায় আমাদের বাসায় এসো।
বিকাল ৫টায় ক্যাপ্টেন আলমগীরের বাসায় গেলাম। অল্পদিন আগে সে বিয়ে করেছিল। ভাবীর সঙ্গে পরিচিত হলাম। ভাবীর ডাকনাম মিনু। ভালো নাম নাদিরা। আমরা বন্ধুরা সবাই তাকে মিনু ভাবী বলেই ডাকতাম। এখান থেকেই আমাদের বন্ধুত্বের শুরু।
আলমগীরের পিতা ক্যাপ্টেন শাহজাহান ছিলেন খুব মার্জিত এবং নমনীয় চরিত্রের মানুষ। কিন্তু মা নূরজাহান বেগম উচ্চ শিক্ষিতা এবং ইডেন গার্লস কলেজের প্রিন্সিপাল হওয়া সত্ত্বেও ছিলেন ভীষণ উগ্র স্বভাবের। আর এ-কারণেই ক্যাপ্টেন আলমগীর পিতৃভবন ত্যাগ করে মোহম্মদপুরের স্যার সৈয়দ আহমেদ রোডে একটি বাসা ভাড়া করতে বাধ্য হন। অথচ মা নূরজাহান বেগম ইডেন গার্লস কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্যধিক সুন্দরী মিনুকে নিজের একমাত্র ছেলের বউ করে এনেছিলেন।
ক্যাপ্টেন আলমগীর মোহম্মদপুরে যে বাসাটা ভাড়া নিয়েছিলেন, সে-বাসাটি ছিল বেশ বড়। ওই বাসার চিলেকোঠার এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। ওই চিলেকোঠায় একসঙ্গে ১২-১৪ জন বসা যেত। ওখানে একটি খাট ছিল। ছিল কয়েকটি চেয়ার এবং একটি বড় আলমারি। ওই আলমারি ভর্তি থাকত পানীয়ের (হার্ড ড্রিংকস) বোতল। আমাদের চিলেকোঠার ডাইহার্ড সদস্য সংখ্যা ছিল ১০-১২ জন পাইলট। এছাড়া সিনিয়র পাইলটদের মধ্যে আমাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন চার-পাঁচজন ক্যাপ্টেন।
১৯৬৯ সাল থেকে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম যে, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে একসময় আমাদের যুদ্ধ করতেই হবে। বিষয়টির গোপনীয়তা রক্ষার জন্য এসব কথা কাউকে বিশ্বাস করে আমরা বলতাম না। শুধু বঙ্গবন্ধু জানতেন বিষয়টি। তার অনুমোদনও ছিল এ ব্যাপারে। আমরা যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করতাম। তারপর জমে উঠত পানীয় পানের আসর। নিচ থেকে মিনু ভাবী খাবার জোগান দিতেন।
পৃষ্ঠপোষকদের নিয়ে হিসাব করলে আমাদের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৪-১৫ জনের বেশি না। মাত্র এই অল্পসংখ্যক সদস্যের মধ্যে পাকবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেনÑ ক্যাপ্টেন আলমগীর, ক্যাপ্টেন সেকেন্দার আলী, ক্যাপ্টেন আমিরুল ইসলাম। আরও একজন আধা বাঙালি পাইলট নিহত হয়েছিলেন পাকবাহিনীর হাতে। তার নাম এনএস হায়দার। তার পিতা বাঙালি হলেও, মা ছিলেন পাঞ্জাবি। তার আপন মামা ছিলেন পাকবাহিনীর মেজর জেনারেল মিঠা খান। পাকবাহিনীর টার্গেট ছিলেন নাসির হায়দার নামের এক বাঙালি পাইলট। যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন। কিন্তু নামের বিভ্রান্তির কারণে মরতে হলো এনএস হায়দারকে।
আমাদের ১৪-১৫ জন সদস্যের মধ্যে শহিদ হয়েছিলেন তিনজন। তিনজন হয়েছিলেন বীরোত্তম খেতাবপ্রাপ্ত এবং দুজন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত। বীরোত্তম খেতাবপ্রাপ্ত হলেনÑ ক্যাপ্টেন শাহাব উদ্দিন, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ, ক্যাপ্টেন সরফুদ্দিন। বীরপ্রতীক পদকপ্রাপ্ত হলেনÑ ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক, ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার (লেখক)। এখানে একটি কথা বলতেই হচ্ছে, এমন অল্পসংখ্যক সদস্যের মধ্যে এতজন শহিদ এবং বীরত্বের জন্য খেতাবপ্রাপ্ত হওয়ার উদাহরণ বোধহয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আর নেই।
অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা ঘটনার কথা বলে নিতে চাই : একাত্তর সালের জানুয়ারি মাস। একদিন ক্যাপ্টেন আলমগীর এবং আমি ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রুটে ফ্লাই করছিলাম। উত্তর প্রান্তের দিক দিয়ে আমরা কুমিল্লা বিমান বন্দরে অবতরণ করতে যাচ্ছিলাম। রানওয়ে থেকে আমরা যখন সামান্য দূরে তখন ক্যাপ্টেন আলমগীর আমাকে কুমিল্লা বিমান বন্দরের রানওয়ের পূর্ব দিকটা দেখিয়ে বলল, দেশের যা অবস্থা তাতে মনে হয় দু-তিন মাসের মধ্যে আমাদের ওপারে অর্থাৎ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। তার বলা কথা যে এমনভাবে সত্যি হবে তা তখন কল্পনাও করতে পারিনি। ২৬ মার্চের পর ক্যাপ্টেন আলমগীর ভারতের পথে রওয়ানা করেও সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কিন্তু শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ঢাকায় ফিরে আসতে হয়।
১৯৭১ সালের ২১ বা ২২ মার্চ ক্যাপ্টেন আলমগীর বললেন, মনে হয় চার-পাঁচ দিনের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালিদের হত্যা করতে শুরু করবে। আমরা যদি ঢাকায় যে তিনটি ফকার প্লেন আছে, তা চালিয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার নামে ফেনীর মতো পরিত্যক্ত রানওয়েতে অবতরণ করে রানওয়ে থেকে আরও দূরে নিয়ে অচল করে রাখি, তেমনি শমসেরনগর বিমানবন্দরে অবতরণ করে একই কাজ করি, তবে পাকিস্তান বাহিনীর চলাচল করতে যথেষ্ট বিঘেœর সৃষ্টি করতে পারব। ওই পরামর্শ অনুযায়ী সেক্টর চিফ পাইলট ক্যাপ্টেন সেকেন্দার আলীকে জানালাম, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ উপেক্ষা করে আমরা কয়েকজন বাঙালি পাইলট ফ্লাইং করতে রাজি, এ-কথা যেন তিনি পাকবাহিনীর জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম রাজাকে জানান। ক্যাপ্টেন সেকেন্দার তা জানিয়েছিলেন। কিন্তু খাদিম রাজা এবং পাকবাহিনীর কর্মকর্তারা এমন ইচ্ছের মধ্যে দূরভিসন্ধি আছে সন্দেহ করে আমাদের ফ্লাই করার অনুমতি দেয়নি।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ থেকে দেশব্যাপী শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। ওই সময় আমরা এবং পিআইএ-র পূর্ব পাকিস্তানে যেসব বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন, তারা সবাই সর্বাত্মকভাবে আন্দোলনে জড়িত হই। আমরা পাইলটরা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশন থেকে আলাদা হয়ে ‘ইস্ট পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করি। এই অ্যাসোসিয়েশনের রেজিস্ট্রেশন পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল। হাইকোর্ট পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছিল। তেজগাঁও আওলাদ হোসেন মার্কেটের কাছে আমরা বড় একটা ঘরে আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের অফিস করলাম।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় পিআইএ-র সব বাঙালি পাইলট এবং কর্মকর্তারা ওই অফিসে একত্রিত হতাম। ওই সময় ঢাকা বিমান বন্দরের টারম্যাক এলাকায় প্রবেশ করা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু কিছু বাঙালি কর্মচারী যেমন পুরান ঢাকার বাসিন্দা অথবা পশ্চিম পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তারা এমন বিশুদ্ধ উর্দু বলতে পারতেন যে পাকবাহিনী তাদের অবাঙালি মনে করত। তারা নিয়মিত চাকরি করতেন। তারা আমাদের প্রচুর সহায়তা করতেন। তারা হিসাবে রাখতেন বেসামরিক পোশাকে কত পাকিস্তানি সেনা আসছে, চীন থেকে মধ্যরাতে কত হাল্কা অস্ত্রশস্ত্র আসছেÑ এসবের হিসাব এনে আমাদের অ্যাসেসিয়েশন অফিসে জমা দিতেন। আমি এসব প্রতিদিন লিখিত আকারে বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে আসতাম। বঙ্গবন্ধু ওই লিখিত কাগজ পকেটে রেখে দিতেন। কোনো প্রতিক্রিয়া তিনি দেখাতেন না। একই সংবাদ তিনি আরও বিভিন্ন সূত্র থেকে পেতেন- এমনটাই আমি মনে করি।
মার্চ মাসের ১৫-১৬ তারিখ বাঙালিদের ওপর ক্র্যাকডাউনের জন্য আরও শক্ত প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সময়ক্ষেপণ করতে ইয়াহিয়া খান সদলবলে ঢাকায় এলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সংলাপ শুরু করলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘৬-দফা’ দাবি থেকে দুটি বা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি বাদ দিতে রাজি হলে একটা সমঝোতা হতে পারে। বঙ্গবন্ধু কোনো ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না। এই সংলাপ চলাকালে আমরা নথিপত্র তৈরি করলাম যে, আমরা একটি আলাদা এয়ারলাইন্স পরিচালনা করতে সক্ষম। বঙ্গবন্ধু সংলাপের মধ্যে আলাদা এয়ারলাইন্সের দাবিও যেন অন্তর্ভুক্ত করেন। এই দাবি নিয়ে আমরা কয়েকজন পাইলট এবং অন্যান্য বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম একদিন সন্ধ্যার পর।
আমাদের তৈরি করা নথিপত্র ক্যাপ্টেন আলমগীর বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়ে আলাদা এয়ারলাইন্সের দাবির কথাও বলল। বঙ্গবন্ধু ওই নথিপত্র না দেখেই আলমগীরের হাতে ফিরিয়ে দিলেন। তারপর ক্যাপ্টেন শাহাব এবং আমাকে একদিকে ডেকে নিয়ে একান্তে বললেন, আরে, দেশটাই তো স্বাধীন করে দিচ্ছি। দেশ স্বাধীন হলে আমাদের নিজস্ব এয়ারলাইন্স তো এমনিতেই হবে।
আমাদের সঙ্গে যারা গিয়েছিলেন, তারা শাহাব এবং আমাকে প্রশ্ন করলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের কী বলেছেন? তিনি যা বললেন তা সবাইকে শুনিয়ে বললাম। সবাই শুনে খুব খুশি মনে আমরা ফিরে এলাম। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে ফিরে আসার আগে আমাদের সবাইকে মিষ্টিমুখ করে আসতে হলো। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যারা দেখা করতে আসছিলেন, তাদের অনেকেই মিষ্টি নিয়ে আসছিলেন। তাই মিষ্টির কমতি ছিল না। আমরা শুধু ভাবছিলাম, বঙ্গবন্ধু এমন আত্মবিশ্বাসী হলেন কেমন করে?
পাকিস্তানিরা ক্র্যাকডাউন করলে ভারত যে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে, সে-ব্যবস্থা তিনি করে গিয়েছিলেন। ভারত সরকারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কেমন করে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন, তা আমার জানা নেই। তবে ভারত যাওয়ার পর জেনেছিলাম, পাকবাহিনী ক্র্যাকডাউন করলে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কে কোথায় অবস্থান করবেন, ২৬ মার্চের আগেই ভারত সরকার তা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন।
২৬ মার্চ পাকবাহিনী যখন বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, তখন আমি আমার মা-স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোনদের নিয়ে ঢাকায় ছিলাম। ২৭ মার্চ কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়েছিল। ওই সময় আমি পুরো পরিবারকে নিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে জিঞ্জিরায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলাম। ওখানে সাত্তার হাজী সাহেবের বাড়িতে দুদিন থেকে, সৈয়দপুর-শ্রীপুর হয়ে মাদারীপুরের বাড়িতে পৌঁছলাম। মা এবং ভাই-বোনদের মাদারীপুরের বাড়িতে রেখে আমার স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বরিশালে আমার মামা বাড়িতে গেলাম। ওখানে দুদিন থেকে আমি ঢাকায় ফিরে এলাম।
ঢাকায় এসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতে যাব। তখন ক্যাপ্টেন রফি বলল, সে আমার সঙ্গে ভারতে যাবে। তবে তার ১২-১৪ দিন দেরি হবে। আমি মনে করলাম, এই সুযোগে মাদারীপুর গিয়ে মায়ের সঙ্গে এবং বরিশাল গিয়ে আমার স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যার সঙ্গে দেখা করে আসি। দ্বিতীয়বার আমি মাদারীপুর-বরিশাল হয়ে ২২ এপ্রিল ঢাকায় এসে পৌঁছলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা-সাতটার দিকে ক্যাপ্টেন আলমগীরদের জিন্দাবাহার লেনের বাসায় গেলাম। ওখানে গিয়ে ক্যাপ্টেন আলমগীর তার বাবা-মা এবং আমি একসঙ্গে বসলাম।
ক্যাপ্টেন আলমগীর কেবল শ্রোতা। কোনো কথা বলছিলেন না। বক্তব্য রাখছিলাম, আমি এবং ক্যাপ্টেন আলমগীরের মা-বাবা। আমি বললাম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করা উচিত। আমরা বাঙালিদের দাবি-দাওয়া এবং সব আন্দোলনে খুব সোচ্চার ছিলাম। পাকবাহিনীর আক্রোশ ক্যাপ্টেন আলমগীর, ক্যাপ্টেন শাহাব এবং আমার ওপরই বেশি। শাহাব তো ইতোমধ্যে ভারত চলে গেছে। ক্যাপ্টেন সেকেন্দার, আমিরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, তা আমরা জানি না। পাকবাহিনীর যাদের ওপর আক্রোশ আছে, তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন আলমগীর এবং আমি আছি তালিকার শীর্ষস্থানে। দেশের ভেতরে থেকে পালিয়ে বেড়ানোও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়া পাকিস্তান বাহিনী যে বাংলাদেশে পরাজিত হবে সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রায় আড়াই হাজার মাইল দূর থেকে (শ্রীলংকা হয়ে ঘুরে আসার জন্য দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল) বাংলাদেশের ওপর দখলদারিত্ব বজায় রাখার মতো শক্তিশালী দেশ পাকিস্তান না। এছাড়া মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হচ্ছে। ভারত তাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে। ভারত সময়মতো বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য আক্রমণ পরিচালনা করবে। আমি কয়েকদিনের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতে চলে যাচ্ছি।
আমার বলা কথা শুনে আলমগীরের বাবা বললেন, কয়েকটা দিন দ্যাখো, তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো। আলমগীরের মা এমন সব কথা বলছিলেন, যা কেবল একজন রাজাকারই বলতে পারে। স্ত্রীর সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদে জড়িত হয়ে ঘরে অশান্তি সৃষ্টি হয়Ñ এমনটা চাচ্ছিলেন না বলেই তিনি খুব নমনীয় ভাষায় কথা বলছিলেন। আমি বাংলাদেশে এমনটা আর দেখিনি, যেখানে স্বামী দেশের স্বাধীনতার পক্ষে এবং স্ত্রী পাকিস্তানের পক্ষে। আলমগীরের মায়ের কথা শুনে মনে হচ্ছিল, যেন তিনি বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ। অথচ তিনি ছিলেন ইডেন গার্লস কলেজের প্রিন্সিপাল। অবশ্য ওই কলেজেও একজন উগ্রপন্থি মহিলা হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। দেশটা স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রীদের আন্দোলনের কারণে তিনি ইডেন গার্লস কলেজ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। বাদানুবাদের কারণে রাত ৯টা বেজে গেল।
আমাকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে ক্যাপ্টেন আলমগীর বাসার দোতলা থেকে নিচে নেমে এলেন। তখন আমাদের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হলো।
আলমগীর বলছিল, আমি মুক্তিযুদ্ধে অবশ্যই যাব। কিন্তু বাবাকে একটু খুশি করে হাজার দশেক টাকা যদি নিতে পারি, তবে ভারতে গেলে অনেকটা সুবিধা হবে।
আমি বললাম, আপনার টাকার খুব একটা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের মুক্তিবাহিনীতে অফিসারদের সংখ্যা খুব কম। আপনি একসময় পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে ছিলেন। সুতরাং নতুন করে আর আপনাকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে হবে না। মুক্তিবাহিনীতে আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ পদেরই দায়িত্ব দেওয়া হবে। মুক্তিবাহিনীতে যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, ভারত সরকার তাদের যথেষ্ট ভাতাও দেয়। পরবর্তীকালে আমি, ক্যাপ্টেন শাহাব, আকরামসহ অন্য পাইলটদের ভারত সরকার ভারতীয় মুদ্রায় ৪০০ টাকা করে ভাতা দিত। সাব-সেক্টর কমান্ডারদেরও ৪০০ টাকা এবং সেক্টর কমান্ডারদের ৫০০ টাকা ভাতা দেওয়া হতো।
অনেক আলাপ-আলোচনার পর আলমগীর তার পিতার কাছ থেকে অর্থপ্রাপ্তির আশা পরিত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য যতটা সম্ভব শীঘ্র ভারতে যেতে রাজি হলেন এবং আমাকে বললেন, কাল সকাল ১০টায় মতিঝিলে পিআইএ অফিসের সামনে এসো। ওখানে ক্যাপ্টেন রফি ও ক্যাপ্টেন জহির আসবে। পূর্বাণী হোটেলে বসে আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব, কীভাবে কোন পথে আমরা ভারতে যাব?
তখন রাত ১০টায় কারফিউ শুরু হতো। তখন রাত ১০টা বেজে গেছে। আমরা আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার জন্য বললাম, তিন-চার দিনের মধ্যে একজন গাইড আমাকে আগরতলা পৌঁছে দেবেন। বর্তমানে তিনি অন্য কয়েকজনকে আগরতলায় নিয়ে গেছেন। তার বাড়ি কুমিল্লায়। বাড়িতে দু-একদিন থেকে তিনি ঢাকায় আসবেন এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তার কাজই হলো, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ঢাকা থেকে আগরতলায় পৌঁছে দেওয়া। তার সঙ্গেই আমরা আগরতলা যাব।
পরের দিন ২৩ এপ্রিল সকাল ১০টার আগেই ক্যাপ্টেন রফি এবং আমি পিআইএ-র মতিঝিল অফিসের সামনে পৌঁছে গেলাম। ক্যাপ্টেন আলমগীর একটি রিকশায় এসে পৌঁছলেন ঠিক ১০টার সময়। রফি এবং আমি মতিঝিল পিআইএ-র সামনে টি বোর্ড ভবনের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। অদূরে দেখছিলাম, আমাদের পরিচিত পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন আরিফ দাঁড়িয়ে আছে।
ক্যাপ্টেন আলমগীর রিকশা থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে আরিফ এগিয়ে এসে তাকে কিছু বলার জন্য ডেকে নিয়ে গেল। আরিফ ক্যাপ্টেন আলমগীরকে নিয়ে কাছেই দাঁড় করানো একটি ভোগস-ওয়াগন গাড়িতে উঠল। গাড়িখানার সামনের আসনে আরিফ এবং ক্যাপ্টেন আলমগীর পাশাপাশি বসেছিল। গাড়ি চালাচ্ছিল ক্যাপ্টেন আরিফ। গাড়িটি চলতে শুরু করল। গাড়িটি যখন আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন দেখতে পেলাম পেছনের আসনে বসে আছে বেসামরিক পোশাকে একজন সৈনিক এবং তার হাতের স্টেনগানের নল ক্যাপ্টেন আলমগীরের মাথায় ঠেকানো।
তখন আমি এবং ক্যাপ্টেন রফি সৈয়দপুরে অবস্থান করছিলাম। সৈয়দপুর যাওয়ার পথে জিঞ্জিরার বাজারে আমার এক বন্ধুর দোকান থেকে ক্যাপ্টেন আলমগীরের বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়ে গেলামÑ আলমগীরকে পাকবাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। একমাত্র পুত্রের মৃত্যুতে ক্যাপ্টেন আলমগীরের পিতা এমন দুঃখ পেয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আর বেশিদিন বাঁচেননি।
এরপর আমি তো মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলাম। সে তো অনেক বড় এক অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধে আমার কার্যক্রম এবং অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গেলে একটি গ্রন্থই রচনা করতে হবে। আজ শুধু মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার আমার অভিজ্ঞতার সূচনা পর্বই লিখলাম।
 
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK