শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
ঢাকা সময়: ০৪:২৩
ব্রেকিং নিউজ

শিথানে শেখ সাহেব

শিথানে শেখ সাহেব

মনি হায়দার
 
কয়দিন ধরে আমবাগানে ঘুরঘুর করে, লোকটা কে রে?
বাসেদের দোকানে চা খেতে এসে জিজ্ঞেস করে মোমিন। আমবাগান থেকে বাসেদের চায়ের দোকান বেশ দূরে। আমবাগানের পাশ দিয়ে একটা বড় রাস্তা গেছে। সেই রাস্তার পাশে বাসেদের চায়ের দোকান। মোমিন এলাকার ছোটখাটো ব্যবসা করে। মেহেরপুরে প্রায়ই আসা-যাওয়া করে। সরকারি দলের ছোটখাটো নেতাও। বৈদ্যনাথতলার আমবাগান থেকে মেহেরপুর পঞ্চাশ মাইল দূর হলেও গ্রামের মানুষ মনে করে অনেক দূর।
আমিও দেখছি মোমিন ভাই রাস্তা দিয়ে আসার সময়ে। বুড়া মানুষ, কী করে বুঝতে পারি না। আমার দোকানে চা-ও খায় মাঝে মধ্যে।
জানতে চাওনি কিছু?
বুড়া মানুষ, কী আর জিজ্ঞেস করবো?
কিন্তু আমার তো সন্দেহ হচ্ছে। একটা লোক খালি খালি আমবাগানে ঘুরঘুর করবে কেনো?
চা খেতে আসা পাশের গ্রাম কেদারগঞ্জের জলিল বলে, লোকটা তো আমগাছগুলোর গোড়ায় শুকনাপাতা, কলাপাতা দিয়া বিছানা তৈরি করেছে।
বলেন কী?
হ্যাঁ, কয়েকদিন আগে এদিকে আসার সময়ে প্রস্রাবের জন্য আমি আমবাগানে ঢুকলে দেখি, মানুষটা শুইয়া আছে।
ঘটনাটা তো খুব সন্দেহজনক, চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে দাঁড়ায়, ঠিক তখনই সেই বুড়ো লোকটা ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। লোকটার পরনে অনেক দিনের পুরনো একটা লুঙ্গি। গায়ের পাঞ্জাবিটা একটু ময়লা হলেও বেশ লম্বা। হাঁটুর নিচে নেমে এসেছে পাঞ্জাবি। মাথার সামনের দিকের অর্ধেক চুল নেই। যা আছে, সেই চুলও অনেকটা লাল। মুখ জোড়া সাদা দাড়ি। ঠোঁটে পানের লাল দাগ। জিহ্বা নাড়ানো দেখে বোঝা যাচ্ছে, মুখে পান এখনও অবশিষ্ট আছে। ওদের মাঝখানে বসার জয়াগায় গিয়ে বসে বৃদ্ধ। তাকায় বাসেদের দিকে, আমারে এক কাপ দা দেন।
দিচ্ছি, বাসেদ তাকায় মোমিনের দিকে, মোমিন ভাই, এই লোকটাই আমবাগানে ঘুরঘুর করে।
মোমিন তীক্ষè চোখে তাকায়। লোকটার মধ্যে আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে না মোমিনের। গ্রামের আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো স্বাভাবিক একজন মানুষ। কিন্তু কেন আমবাগানে ঘুরঘুর করছে? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।
চাচা, আপনার বাড়ি কোথায়? বাসেদের দেয়া চায়ের কাপে মাত্র চুমুক দিয়েছে, মোমিনের প্রশ্নে মুখের চাটুকু দ্রুত গিলে উত্তর দেয়, আমার বাড়ি জগন্নাথপুর।
প্রায় মাইল দুয়েক দূরের গ্রাম। আমবাগানে কী করেন?
চায়ের কাপে দীর্ঘ একটা চুমুক দিয়ে, চাটুকু গলধকরণ করে তৃপ্তির সঙ্গে বলে, একজনার জন্য অপেক্ষা করছি। মানুষটা আসলে একটা স্যালুট দেবো।
বৃদ্ধের কথায় সবার আগ্রহ তৈরি হয়। প্রত্যেকে তাকিয়ে আছে বৃদ্ধের দিকে। মোমিন ভাবে, লোকটার মাথা ঠিক আছে? গ্রামে আজকাল প্রচুর বয়স্ক লোক পাগল হচ্ছে। এই লোকটাও পাগল হয়ে গেছে? জিজ্ঞেস করে, চাচা আপনার নাম কী?
রফিকউদ্দিন।
বাড়িতে কে কে আছে আপনার?
বাড়িতে ছেলে আছে, মেয়ে আছে। ছেলের ঘরের নাতি আছে। কিন্তু আমার স্ত্রী নাই। গত বছর মারা গেছে।
সবই তো ঠিক বলছে রফিকউদ্দিন, তাহলে? মোমিন কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। প্রশ্ন করে, আপনি কাকে স্যালুট দেবেন চাচা?
আমাদের দেশে একজন মানুষই তো আছেন, যাকে স্যালুট দেয়া যায়।
কার কথা বলছেন আপনি?
শেখ সাহেবের কথা বলছি।
মোমিন, বাসেদ, জলিল একসঙ্গে বলেÑ বলেন কী আপনি?
রফিকউদ্দিন খুব শান্তগলায় বলে, বাজান। আমি এই বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর সরকারকে স্যালুট দিছি। আনসারে আছিলাম তো। সেই সময় এসপি মাহবুব আর মহকুমার বড় অফিসার এলাহি সাহেব আমাদের ডেকে বললো, এই আমবাগানে বাংলাদেশের নতুন সরকার শপথ নেবে। তাজউদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম সাহেব আসবেন। ওসমানী সাহেব আসবেন, দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরা আসবে। আমরা এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নতুন সরকার রে স্যালুট দিবার জন্য তৈরি হলাম। আমরা উত্তেজনায় কাঁপতেছি। একসময়ে সবাই আসলো। শপথ অনুষ্ঠান হলো। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে স্যালুট দিলাম। দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরা ছিল, দেখলো, ফটো তুললো। আবার সবাই চলে গেলো। সেই ঘটনার পর তো যুদ্ধ আর যুদ্ধ। আমরাও যুদ্ধ করলাম। দেশ স্বাধীন হলো। আমার আনসারের চাকরি ছিল দুই বছর। চাকরিও শেষ কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটা আশা, যার নামে যুদ্ধ করলাম, যার নামের সরকারকে স্যালুট দিলাম, সেই শেখ মুজিবকে আমি একটা স্যালুট দিতে চাই। আর কয়দিন বা বাঁচবো? মরার আগে আমার ইচ্ছা শেখ সাহেবকে একটা স্যালুট দেওয়া।
রফিকউদ্দিনের ঘটনা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তিনজনে শোনে। চা খাওয়া শেষ হলে কাপটা বাড়িয়ে ধরে বাসেদের দিকে। বাসেদ কাপটা নিয়ে তাকিয়ে থাকে মানুষটার দিকে, আপনের কী মাথা ঠিক আছে?
আমার মাথার কী হলো বাবা?
দেশে এখন জটিল অবস্থা। বঙ্গবন্ধুর কী সময় আছে এইখানে আসার?
নিজের নামে একটা দেশের নাম হয়েছে, মুজিবনগর। শেখ সাহেব দেখতে আসবে না? আজ না হলে কাল, কাল না হলে পরশু, একদিন না একদিন আসবে শেখ সাহেব। আসলেই স্যালুট দেবো। আর এই যে আমার সঙ্গে পুঁটলিটা দেখছেন, এই পুঁটলির মধ্যে মুজিবনগর সরকারকে স্যালুট দেয়ার সময় যে খাকি প্যান্ট আর জামা পরেছিলাম, সব আছে। শেখ সাহেব আসলেই এই পোশাক পরে একটা স্যালুট দিয়া বাড়ি যাবো… রফিকউদ্দিনের কুঁচকানো মুখটার ওপর আকাশের রং ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু আপনি আমবাগানে থাকেন কেনো? প্রশ্ন করে মোমিন।
আমার বাড়ি এখান থেকে দুই তিন মাইল দূরে, জগন্নাথপুরে। শেখ সাহেব ব্যস্ত মানুষ, কখন এসে চলে যায়, ঠিক নাই। বাড়িতে থাকলে তো কিছুই জানতে পারবো না। সে-জন্যই আমবাগানে থাকি…
রাতেও থাকেন?
ঘাড় নাড়ে রফিকউদ্দিন, থাকি।
আপনার ভয় করে না?
নাহ, আমি বুড়া মানুষ। আমার এক পা কবরে। আমাকে কে কী করবে? অবশ্য রাইতে আমবাগানের মধ্যে শিয়াল, সাপ, বেজি দেখতে পাই। ওরাও আমাকে কিছু বলে না। আমিও ওদের কিছু বলি না। মাঝে মধ্যে আমার বড় পোলা রবিনে খুঁজে বাড়ি নিয়া যায়। থাকি দুই-চার দিন, আবার এসে পড়ি আমতলায়। যদি শেখ সাহেব এসে চলে যায়, তাহলে তো আমার স্যালুট দেওয়া হবে না।
মোমিন হতবাক। কী বলবে, কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। তাকায় বাসেদের দিকে, বাসেদ চাচা তোমার দোকানে যখন যা চাবে, দিয়ে দিবে। আর তোমার খাতায় লেখে রাখবে। দাম আমি দেবো।
না বাবা, আমার জন্য আপনার চিন্তা করতে হবে না। আনসারের চাকরি থেকে আমি মাসে দুইশ টাকা পাই। আর গ্রামে আমার কিছু জমি আছে, চলে যায়… আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা করা লাগবে না, খুব সরল অভিব্যক্তিতে বলে রফিকউদ্দিন।
এক কাজ করেন চাচা, মুখ বাড়ায় জলিল, শেখ সাহেবের এখন অনেক কাজ ঢাকায়। এদিকে আসলেও অনেক পরে আসবে। তার চেয়ে আপনি ঢাকা চলে যান…
প্রবলভাবে ঘাড় নাড়ে রফিকউদ্দিন, আমি কোনোদিন ঢাকা যাই নাই। কেউ নাই আমার ঢাকা শহরে। আর শেখ সাহেব কোথায় থাকে, জানি না। এই আমবাগানে, নিজের নামের এলাকায় একবারও কী আসবে না শেখ সাহেব? আমি তো শেখ সাহেবের আসার আশায় আছি। এই আমবাগানেই আমি স্যালুটটা দিতে চাই শেখ সাহেবকে। ঢাকায় গেলে এই আমবাগানের স্যালুট দেওয়ার সুখ পাবো না বাজান।
মাথা নাড়ায় বাসেদ, ঠিকই বলেছেন। ঢাকায় গেলে আপনি কোনো দিশা পাবেন না চাচা। ঢাকা অনেক বড় শহর। আমার চাচায় চাকরি করে মতিঝিলে, শুনছি খালি মানুষ আর মানুষ।
ঘাড় নাড়ায় রফিকউদ্দিন, জি। আমিও শুনছি।
মোমিন, জলিল কাজের তাড়ায় চলে যায়। একটু পর রফিকউদ্দিনও উঠে আমবাগানের দিকে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। বাসেদ তাকিয়ে থাকে রফিকউদ্দিনের দিকে। বলে কী মানুষটা, রাতেও থাকে আমবাগানে? ভয়ডর বলতে কী কিছু নেই? না-কি অন্য কোনো ষড়যন্ত্র আছে? না-কি আমবাগান দখলের কোনো পরিকল্পনা করছে কেউ? এখন তো দখলের পালা চলছে দেশে।
বাসেদের চায়ের দোকানে বসে রফিকউদ্দিনের বলা ঘটনা, দু-একদিনের মধ্যে গোটা কেদারগঞ্জ ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকজন রফিকউদ্দিনকে দেখতে আসে। সবার সঙ্গে আমবাগানের বড় আমগাছটার নিচে, যেখানে নিজের থাকার জায়গা করেছে, বসে বসে গল্প করে। নিজের জীবনের একমাত্র ইচ্ছে শোনায়। কেউ পছন্দ করে। কেউ হাসে। অধিকাংশই বলে, পাগলের পাগলামি। কিন্তু রফিকউদ্দিন নিজের ইচ্ছের কাছে সমর্পিত একজন মানুষ। মাঝখানে কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে রফিকউদ্দিনের ছেলে রবিন এসে বাবাকে নিয়ে যায়। কয়েকদিন তুমুল বৃষ্টি। গ্রামের রাস্তাঘাট সব পানিতে ডুবে একাকার।
প্রায় পনেরো-বিশ দিন পরে বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে ফিরে আসে রফিকউদ্দিন। এসে রেখে যাওয়া বিছানা পায় না। দেখতে পায় বিছানাটা কেউ ছিঁড়ে দূরে রেখে দিয়েছে। আর কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ভিজে একবারে ছুপছুপা। বাসেদের দোকানে যায়, দোকান বন্ধ। ইতোমধ্যে সন্ধ্যেও হয়ে আসছে, কী করবে রফিকউদ্দিন ভেবে পায় না। একেবারে মাটির ওপর শোবে? কী আর করা আমবাগানের বড় আমগাছটার নিচে গিয়ে, গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে।
কয়েকদিন পরে মোমিনের চেষ্টায় একজন সাংবাদিক আসে মেহেরপুর থেকে। দেশের প্রাচীন পত্রিকার মফস্বল সংবাদদাতা মকবুল হোসেন এসে সাক্ষাৎকার নেয় রফিকউদ্দিনের। সঙ্গে ক্যামেরায় কয়েকটা ছবিও নিয়ে যায়। যাবার সময়ে বলে যায়, চাচা আমার পত্রিকায় আপনার ছবিসহ পুরো সাক্ষাৎকারটা ছাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবো। এই খবর আর ছবি দেখার পর নেতা ঠিকই আপনার স্যালুট নেওয়ার জন্য চলে আসবে মুজিবনগরে।
আমিই তো সেটাই চাই, বাজানÑ ফোকলা দাঁতে বৃদ্ধ রফিকউদ্দিন হাসতে থাকে।
এতদিন ঘটনা ছিল রফিকউদ্দিনের একান্ত নিজের। কিন্তু সাংবাদিক আসায়, ছবি তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় এলাকার লোকজনের মধ্যেও একটা আশা তৈরি হয়। এইবার নেতা আসলেও আসতে পারে, যত ব্যস্ততাই থাকুক। এলাকার লোকজনের মধ্যে এক ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়। নেতা এতদিনে মুজিবনগরে না আসায় অবরুদ্ধ অভিমানও উথলে ওঠে। যে যার মতো বাসেদের চায়ের দোকানে চা পানের সঙ্গে তর্কবিতর্কের ঝড়ে মত্ত হয়।
মুজিবনগর, জগন্নাথপুর, কেদারগঞ্জ এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বর আর লোকজন খুব ঘনঘন খোঁজখবর নেয় রফিকউদ্দিনের। জগন্নাথপুরের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান একদিন দলবল নিয়ে এসে দেখা করেছে রফিকউদ্দিনের সঙ্গে। আমগাছের নিচে একা এভাবে থাকতে দেখে খুব দুঃখ করে বলে, চাচা আপনি আমাকে আগে বলবেন না? আমি আপনার থাকার একটা একচালা সুন্দর মজবুত ঘর তুলে দিই?
দুদিকে প্রবল মাথা নাড়ে রফিকউদ্দিন, না বাজান না। আমি যেভাবে আছি এইভাবেই থাকতে দাও। আমি তো আমগাছের তলায় সারাজীবন থাকতে আসি নাই। শেখ সাহেবকে স্যালুটটা দিয়াই বাড়ি যাবো। বয়স হয়েছে, বাঁচবো আর কয়দিন?
কিন্তু নেতা এসে যদি দেখে আপনি এভাবে আছেন, আমি চেয়ারম্যান ইউনিয়নের, আপনার কোনো যতœ নেই নাই, নেতা তো রাগ করবে আমার ওপর।
উদাস হাসে রফিকউদ্দিন, আমাদের নেতা আমাকে বুঝবে। রাগ করবে না।
রাজি করাতে না পেরে দলবল নিয়ে চলে যায় জগন্নাথপুরের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান। পরের দিন আসে কেদারগঞ্জের চেয়ারম্যান রহিমউদ্দিন। সব দেখে-শুনে রহিমউদ্দিন বলে, এই জঙ্গলে ভূত-প্রেত ছাড়া কোনো মানুষ থাকে চাচা? আপনি আমাকে জানাবেন না ঘটনা? আমি লোকমুখে শুনেই চলে এলাম। আমি আপনার জন্য একটা পাকা ঘর তৈরি করে দিচ্ছি। লগে মধু মিস্ত্রীকে নিয়ে এসেছি। মধু, তুমি মাপজোখ করে দেখো… কত পরিমাণ ইট বালু সিমেন্ট লাগবে…
রফিকউদ্দিন হাত ধরে চেয়ারম্যানের, বাজান আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। আমার ইটের ঘর লাগবে না। আমার তো একটাই ইচ্ছা শেখ সাহেবকে একটা স্যালুট দেওয়া। শেখ সাহেব আসলে একটা বড় স্যালুট দিয়া বাড়ি যাবো। আমাকে নিয়ে পত্রিকায় একটা লেখা ছাপা হয়েছে শুনেছি। তুমি কী বলতে পারো, শেখ সাহেব কী লেখাটা দেখেছে?
লেখা যখন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তখন নিশ্চয়ই দেখেছে নেতাÑ চেয়ারম্যান দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দেয়।
গভীর প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে রফিকউদ্দিনের মুখে। নিশ্চিত হলো মনে মনে, অল্পদিনের মধ্যেই শেখ সাহেব আসবে। একটা স্যালুট দিয়া বাড়ি ফিরে যাবেন রফিকউদ্দিন। পরম নিশ্চিত। আমতলায় এখন প্রায়ই লোকজনের একটা জমায়েত লেগে থাকে। রফিকউদ্দিনের খারাপ লাগে না। ছেলে রবিনও আসে, মানুষের উপস্থিতি দেখে ভালোই লাগে। গোটা এলাকার অপেক্ষার মধ্যে এক শ্রাবণ সকালে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে মেহেরপুর কেদারগঞ্জ আর জগন্নাথপুরের লোকজন শোনে একটা বেতারের তরঙ্গে একটি বিষাক্ত কণ্ঠ, আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশÑ জিন্দাবাদ।
গোটা দেশের মতো পাষাণ নীরবতা নেমে আসে মেহেরপুরে, জগন্নাথপুরে, কেদারগঞ্জে এবং মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে। দোকানদার বাসেদ ছুটে আসে রফিকউদ্দিনের কাছে, চাচা খবর শুনেছেন?
বিছানায় শুয়ে ছিলেন রফিকউদ্দিন। বাসেদের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে উঠে বসে, শেখ সাহেব এসেছেন?
না চাচা, শেখ সাহেবকে তো মেরে ফেলেছে…
দূর মিয়া, কী না কী বলো। শেখ সাহেবকে মারকে কে? আবার বিছানায় শুয়ে পরে রফিকউদ্দিন, তাকে মারতে পারে এমন বাঙালি এখনও দুনিয়ায় পয়দা হয় নাই।
চাচা, সত্যি বলছি…
বাজান আমার সঙ্গে ব্যাজর ব্যাজর না করে দোকানে যাও…।
বিরক্ত রফিকউদ্দিনের রাগ-কথায় আহত বাসেদ চলে যায় দোকানে। কিন্তু বাসেদ দোকানে গেলেও একই সংবাদ একের পর এক এসে জানিয়ে যায় রফিকউদ্দিনকে। বিরক্তির সঙ্গে শুনে রাগে ফেটে পড়ে। ফলে কেউ আর আসে না। দুদিন পর থানার তিনজন পুলিশ এসে দাঁড়ায় মুজিবনগরের আমবাগানের বড় আমগাছটার নিচে। লতাপাতার ওপর পুরনো হোগলা বিছানো বিছানায় শোয়া বৃদ্ধকে দেখে এএসআই মহিবুর রহমান হতবাক। অথচ ওসি বলেছে, এক বড় দুষ্কৃতকারী লুকিয়ে আছে।
চাচা, আপনি এখানে কী করেন?
দেখতে পাচ্ছেন না চোখে আমি শুইয়া আছি।
বাড়িঘর রেখে এই গভীর আমবাগানে কেন শুয়ে আছেন?
আমি শুইয়া থাকলে আপনাদের কী বাজান?
মহিবুর বুঝতে পারে কোথাও একটা ঝামেলা তৈরি হয়েছে। এই কংকালসার বৃদ্ধ কোনোভাবেই দুষ্কৃতকারী হতে পারে না। মনে পড়ে পিতা আহিরউদ্দিনকে। পিতা আহিরউদ্দিন এভাবে কংকালসার জীবন নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে নড়াইলে চিত্রা নদীর পাড়ে।
কিন্তু ওসি মোদ্দাবের মিয়া বলেছে, লোকটাকে ধরে থানায় নিয়ে আসবে। সে না-কি শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করার জন্য আমবাগানে অস্ত্রশস্ত্র জমা করছে।
ওসির কথার সূত্র ধরে মহিবুল তাকায় কনস্টেবল জয়নালের দিকে, তোমার কী মনে হয়? এই বৃদ্ধ লোকটি মুজিব হত্যার প্রতিশোধের জন্য অস্ত্রশস্ত্র জমা করছে এই জঙ্গলে?
স্যার, আমাদের যুক্তি ওসি স্যারে মানবে না। তার চেয়ে উনাকে নিয়ে চলেন, যা করার ওসি স্যার নিজেই করবে।
এএসআই মহিবুর বুঝতে পারে কনস্টেবল জয়নালের কথাই ঠিক। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ^াস বের হয়, চাচা? আপনাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে। উঠুন।
থানায় কেন? শোয়া থেকে বসে রফিকউদ্দিন, শেখ সাহেব কী থানায় এসেছেন?
হতভম্ব মহিবুর, কোন শেখ সাহেব?
বিরক্তি প্রকাশ করে রফিকউদ্দিনÑ এই দেশে শেখ সাহেব কয়জন? একজন। হারামজাদারা আমাকে বলে বিশাল মানুষটাকে না-কি মেরে ফেলেছে! আরে শেখ সাহেবকে মারা এত সোজা? কার আছে বুকের পাটা ওই রকম মানুষটার বুকে গুলি মারে? বলতে বলতে দাঁড়ায়, চলুন। সঙ্গে পুঁটলিটা নেয়, আমার কী? যে যা বলে বলুক। আমি স্যালুটটা দিয়ে বাড়ি গিয়ে একটা ঘুম দেবো। অনেক রাইত ভালো করে ঘুমাতে পারি না। বাদুড়, হুতুমপেঁচা, শিয়াল, সাপ আর ব্যাঙের ডাকাডাকিতে ঘুম আসে না। চলেন…
তিনজন পুলিশের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে দাঁড়ায় রফিকউদ্দিন, আচ্ছা শেখ সাহেব এসে পড়েছে না আসতেছে?
চাচা আপনে কী বলছেন, কিছুই বুঝতে পারছি না, বলে মহিবুল।
তোমরা কোন দেশের পুলিশ, কী চাকরি করো বুঝি না, খামোশ হয়ে যায় বৃদ্ধ রফিকউদ্দিন। বড় রাস্তায় উঠে পুলিশের একটা ভ্যানে চড়ে চারজন। ভ্যান চলতে শুরু করে। রফিকউদ্দিন কাশে। গত কয়েকদিন ধরে কাশিটা বেড়েছে। রফিকউদ্দিন কাশতে কাশতে ভ্যানগাড়ি থানায় পৌঁছে যায়। থানার ওসি মোদ্দাব্বের মিয়া আসামি দেখে হতবাক, এ কাকে এনেছো তোমরা?
স্যার, আসামি। মুজিবনগরের আমবাগানের বড় আমগাছটার নিচে এই লোক শুয়েছিল, আপনি বলেছিলেন ধরে আনতে, ধরে আনলাম, এক নিঃশ^াসে বলে মহিবুল।
কিন্তু এই লোক নিজেই হাঁটতে পারে না। সে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে করবে? চিন্তিত ওসি মোদাব্বের মিয়া।
আমিও সেটা বলছিলাম স্যার…
মহিবুরের কথা শেষ হতে পারে না, খেঁকিয়ে ওঠে ওসিÑ দুই ইউনিয়নের দুই চেয়ারম্যান, নতুন সরকারের ঘেটু ইলিয়াস মিয়া এসে তো বললো…
স্যার ইলিয়াস মিয়া তো একাত্তরের বড় রাজাকার ছিল। এই এলাকার অনেক লোককে হত্যা করেছে, বাড়িঘর পুড়িয়েছেÑ কনেস্টেবল আহাদ হোসেন বলে।
এটা জানো, আর ওইটা জানো না?
কোনটা স্যার?
ওই হারামজাদারা যে দালাল আইনে আটক ছিল, সেই দালাল আইনটা সামরিক সরকার তুলে নিয়েছে। তুলে নেওয়ার কারণে খুনিরা জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। এলাকায় এসে নতুন করে গোঁফে ঘি মাখছে সামরিক সরকারের।
এএসআই মহিবুরের অবাক কণ্ঠ, খুনিদের ছেড়ে দিয়েছে সরকার?
মাথা নাড়ায় ওসি মোদাব্বির, জি জনাব।
ওসির ঠাট্টা মেনে নিয়ে প্রশ্ন করে মহিবুর, স্যার বৃদ্ধ লোকটাকে কী করবেন?
কিচ্ছু করার নাই। লকআপে ঢুকাও।
বৃদ্ধ রফিকউদ্দিনকে লকআপে ঢুকালে মেঝেতে বসে জিজ্ঞেস করে, শেখ সাব আসে নাই?
আসতেছে। আপনি অপেক্ষা করুন, কনস্টেবল ইন্দকুমার সাহা লকআপের তালা আটকাতে আটকাতে বলে। আপনি চুপচাপ বসে থাকুন। শেখ সাহেব আসলে আপনাকে জানাবো।
আচ্ছা! বৃদ্ধ রফিকউদ্দিন কাশতে কাশতে পাকা সানের ওপর শুয়ে পড়ে। লকআপে বৃদ্ধের তিন দিন চার রাত কেটে যায়। দেশের অবস্থা সুতার ওপর। প্রত্যন্ত এলাকায় রাজধানীর খবর আসতে আসতে বাসিপচা হয়ে আসে। পচাবাসি খবরের ওপর নতুন খবরের জন্ম হয়। মানুষ বিভ্রান্তির জালে আটকা পড়ে। কেউ কেউ বিভ্রান্তির জালের মধ্যে সাঁতার কেটে নতুন মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। টালমাটাল সময়ের মধ্যে বৃদ্ধ রফিকউদ্দিনের ছেলে রবিন আসে থানায়। ওসিকে বোঝায়, আমার বাবা খুব সাধারণ মানুষ। দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এখন বয়স হয়েছে তো, ছেড়ে দেন…
এএসআই মহিবুরও সমর্থন করে, স্যার বৃদ্ধ মানুষটার নামে তো কোনো অভিযোগ নাই। ছেড়ে দেন।
আমিও তো বুঝি সব। কিন্তু রাজনীতির বাও বাতাস এখন স্থির নাই। সামরিক আইনের গোলাগুলির মতো রাজনীতি গুত্তা মারতেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ঠিক আছে। ছাইড়া দাও।
রফিকউদ্দিনকে নিয়ে বাড়ি আসে রবিন। বাবাকে গোছল করিয়ে ভালো জামাকাপড় পরিয়ে গরম ভাত খেতে দেয়। বৃদ্ধ কই মাছের ঝোল দিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সন্ধ্যার পরপরই। কিন্তু সকালে উঠে আর রবিন পিতাকে পায় না। বুঝতে পারে, পিতা চলে গেছে আমবাগানে, মুজিবনগরে, আমগাছের তলায় শেখ মুজিবকে স্যালুট দেওয়ার জন্য। চোখ ফেটে কান্না আসে, এই মানুষটাকে কী করে বোঝাবে ওরা শেখ মুজিবকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে প্রায় সপরিবারে। দুটি মেয়ে বেঁচে গেছে দেশের বাইরে থাকায়। কিন্তু যতভাবেই বলা হোক না কেন, রফিকউদ্দিন বুঝবে না।
বাসেদের চা দোকানের চা জ্বালানোর জন্য শুকনো কাঠ প্রয়োজন। কাঠ কুড়াতে আমবাগানে ঢুকেছে। ধারণা ছিল, বৃদ্ধ রফিকউদ্দিন এখনও থানায়। উনাকে থানায় নিয়ে যাওয়ায় ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ ছিল বাসেদ। মনে মনে বলতো, ক্ষমতার সঙ্গে তো কিছু পারো না। বৃদ্ধ মানুষটারে জেলে ঢুকিয়ে ক্ষমতা দেখাচ্ছো!
আমবাগানের বড় আমগাছটার কাছে এসে অবাক বাসেদ। রফিকউদ্দিন সোজা শুয়ে আছে। বুক পিঠের সঙ্গে লেগে গেছে। আরও একটু কাছে যাওয়ার পর বুঝতে পারে, রফিকউদ্দিন আর বেঁচে নেই। দাঁতবিহীন মুখের হা গহ্বরে মাছি ভনভন করছে। আহা রে… শেখ সাহেব শেখ সাহেব করে শেষ পর্যন্ত লোকটা আমতলায়ই মারা গেলো!
বাসেদ দৌড়ে বড় রাস্তায় ওঠে। যাকে পায় তাকেই বলে, রফিকউদ্দিন আমতলায় মরে পড়ে আছে।
সত্যি?
আমি নিজের চোখে দেখলাম।
খবর শুনে লোকজন ছুটে আসে। আমতলায় এক নিথর বেদনার সুর বাজে প্রত্যেকের অন্তরের মাঝে। মনে হচ্ছে দুপুরের আমবাগানের প্রত্যেকটা গাছ, প্রত্যেকটা পাতা শোকে থৈ থৈ কাঁদছে। প্রায় ত্রি-পঁয়ত্রিশ জন তরুণ বৃদ্ধ শিশু দাঁড়িয়ে দেখছে মৃত রফিকউদ্দিনকে। হঠাৎ বাসেদের আট বছরের ছেলে কাসেদ বৃদ্ধের শিথানে দেখতে পায় একটা ছবি।
কাসেদ তুলে হাতে নেয়। সবাই তাকায়, ছবিটা শেখ মুজিবের। সাদা-কালো। অনেক আগের কোনো পত্রিকায় ছাপানো ছবিটা বেশ বড়… শেখ মুজিব বিশাল জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন চিরায়ত প্রথায় হাত উঁচু করে, অঙ্গুলি নির্দেশ করে।
 
লেখক : গল্পকার

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK