শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
ঢাকা সময়: ০০:৫৬
ব্রেকিং নিউজ

যুবলীগ : অগ্রসর চিন্তার পথ

যুবলীগ : অগ্রসর চিন্তার পথ

মোহাম্মদ হানিফ হোসেন

যুবলীগ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম যুব সংগঠন। যুব-সমাজের ঐক্যের ধারক হিসেবে সংগঠনটি আজ বহুল পরিচিত। এটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুব অঙ্গসংগঠন। সংগঠনটরি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই শেখ ফজলুল হক মণি আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ছিল সোনার বাংলাদেশ গড়ার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করা। প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু যুব নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘যুব সমাজকে চিত্ত চাঞ্চল্য, চিত্ত দৌর্বল্য পরিহার করে সোনার বাংলার সঠিক সৈনিক তৈরীর দায়িত্ব তোমাদের উপরে রইল।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক যুব-কনভেশনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু সংগঠনটির। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মণি ভাইয়ের আদর্শিক চেতনার প্রতিফলন যুবলীগ। যুবলীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সদ্যস্বাধীন বাংলার যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে অপশক্তির সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়া হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে আধুনিক কাঠামোয় পুনর্গঠন, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আত্মপ্রত্যয়ী প্রগতিশীল যুবশক্তিকে কাজে লাগাতে একটি যুবসংগঠন প্রতিষ্ঠা ছিল সময়ের দাবি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুবলীগের নেতা-কর্মীরা দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করে। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক ধরে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম এবং হাজারো নেতা-কর্মীর আত্মত্যাগের মাধ্যমে যুবলীগ আজ দেশের সর্ববৃহৎ যুব সংগঠন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, শোষণমুক্ত সমাজ অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচার, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা জাতীয় চার মূলনীতিকে সামনে রেখে বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র দূরীকরণ, দারিদ্রবিমোচন, শিক্ষা সম্প্রসারণ, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং যুবসমাজের ন্যায্য অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক ভূমিকা রেখে আসছে সংগঠনটি।

শেখ মণি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬০-১৯৬৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় কারাবরণ করেন। ১৯৬৫ সালেও তিনি পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন এবং দেড়বছর কারাভোগ করেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয়-দফা আন্দোলনে অগ্রণী ভ‚মিকা পালনের দায়ে তিনি কারারুদ্ধ হন। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় অন্যদের সাথে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর উদ্যোগে মুজিববাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি হিসেবে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি সাংবাদিকতায় ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন শেখ মণি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বাংলার বাণী পত্রিকা দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্ট তিনি সাপ্তাহিক সিনেমা পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৭৪ সালের ৭ জুন তাঁর সম্পাদনায় ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস প্রকাশিত হয়। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠিত হলে তিনি এর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মনোনীত হন। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট কালরাত্রিতে ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি নিহত হন। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঐতিহ্য এবং সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আজ বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ গৌরবময় অধ্যায়ে।

১১ নভেম্বর যুবলীগের ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী । নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী পালিত হবে সংগঠনটির জন্মদিন। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ  দেশ-বিদেশের প্রতিটি ইউনিটে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে।  শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে যুবলীগের প্রতিটি ইউনিট জনকল্যাণকর নানা কর্মসূচি পালন করবে। সংগঠনের সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ এবং সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল দেশবাসীসহ যুবসমাজকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে সংগঠনটি আজ সমহিমায় উদ্ভাসিত। বিগত সময়ে এক অমানিশার ছায়া ভেদ করেছিল সংগঠনটিকে। ক্ষমতাসীন সংগঠনের সহযোগী সংগঠন হিসেবে যুবলীগের সাংগঠনিক পরিচয়ে কেউ কেউ অনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার করেছিল। সংগঠনের ঢাকা মহানগর কমিটি থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতৃত্বে কারও কারও বিরুদ্ধে ক্লাব পরিচালনার আড়ালে অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো ব্যবসার অভিযোগ ওঠে। সব মিলিয়ে এক সময় ভাবমূর্তির সংকটে পড়ে এই সংগঠনটি। তবে এসব অপরাধ দলের কাছে প্রশ্রয় পায়নি। অভিযোগে কেউ কেউ গ্রেফতারও হয়েছেন। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির অভিযোগেও কেউ কেউ বহিষ্কৃত হন। অনেকেই আইনের আওতায় যা সমকালীন রাজনীতিতে অনন্য দৃষ্টান্ত।

অবশেষে ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর যুবলীগের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। যুবলীগের কংগ্রেসে চেয়ারম্যান হিসেবে হাল ধরেন অধ্যাপক শেখ ফজলে শামস পরশ। যার পরিচয় যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বড় ছেলে। শেখ মণি’র গর্বিত উত্তরাধিকার। পিতার আদর্শিক চেতনায় যুবলীগ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দেশপ্রেম ও সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষায় মানবিক যুবলীগের সুখ্যাতি অর্জনে সংগঠনের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ সর্বাধিক মনোনিবেশ করেছেন। পিতা থেকে পুত্র দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঐতিহ্য এবং সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আজ বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ সমহিমায়। স্মার্ট, নির্ভীক ও স্বচ্ছ নেতৃত্ব দানকারী হিসেবে ইতোমধ্যে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তৃণমূলের নেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা মাইনুল হোসেন খান নিখিল। যুবলীগের শীর্ষ দুই পদের নেতৃত্ব সমন্বয়ে কেবল ভাবমূর্তিতে স্বচ্ছ নয়, রাজপথের নির্ভীক ও সাহসী নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত রাখেন তারা।

দায়িত্ব গ্রহণের পর পরশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো যুবলীগের অতীত গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করা, যুবলীগের প্রতি যুব সমাজ তথা আপামর জনসাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং যুবলীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমুন্নত করা। এতে তিনি সফল হন। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি সুদৃঢ় অবস্থান নেন। এরইমধ্যে বৈশ্বিক মহামারী করোনার ঢেউ আঘাত হানে বাংলাদেশে। সেই সাথে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়। গত দুই বছর ধরে এসকল সংকটজনক পরিস্থিতিতে যুবলীগ তার মানবিক ভাবমূর্তি দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠিত করে আসছে। যুবলীগ দেশব্যাপী স্বাস্থ্যবিধি প্রচারের পাশাপাশি মাস্ক, হ্যান্ড সেনিটাইজার, হেক্সাসল, সাবান বিতরণ করে। সরাসরি অর্ধ কোটি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দান করে। বস্তিবাসীদের নিয়মিত খাবার পৌঁছে দেয়। ঢাকা মহানগর ও বিভিন্ন জেলা, উপজেলা পর্যায়ে ২৪ ঘণ্টা ফ্রি এম্বুলেন্স সার্ভিস ও ২৪ ঘণ্টা টেলিমেডিসিন সার্ভিস প্রদান করে। চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করে। শ্রমিক সংকটে কৃষকের ধান কেটে সহায়তা করে যুবলীগ। রমজান মাসে ইফতার ও রান্না করা খাবার বিতরণ করে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দেশব্যাপী বৃক্ষরোপন কর্মসূচিও পালন করে যুবলীগ।

ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো অযোগ্য এবং বিতর্কিতদের সংগঠন থেকে সরিয়ে শিক্ষিত, মেধাবী, ত্যাগী, যোগ্য ও পরিচ্ছন্ন যুবকদের নেতৃত্বে নিয়ে আসা। এই চ্যালেঞ্জও দারুণ দক্ষতায় উৎরে যান শেখ পরশ। সব শ্রেণী ও পেশার মধ্য থেকে অধিকতর যোগ্য ২০১ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাহী কমিটি ও ২০০ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন তরুণ আইনপ্রণেতা, আইনজীবী, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, সংস্কৃতিকর্মী ও সাবেক ছাত্রনেতা। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা আর অগ্রসর চিন্তার পথ যেভাবে যুবলীগকে এগিয়ে নিয়ে চলছে তা যুব রাজনীতিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করলো। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এইদিনে আমাদের প্রত্যাশা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে শেখ হাসিনার হাতকে আরও শক্তিশালী করবে আগামীর যুবলীগ। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। শুভ জন্মদিন আমার প্রিয় সংগঠন।

লেখক : রাজনৈতিক কর্মী




 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK