শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১০:১৩
ব্রেকিং নিউজ

ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড কেন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অপরিহার্য?

ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড কেন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অপরিহার্য?

সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ
 
বয়স হওয়ার সাথে সাথে আমরা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে শুরু করি। আমাদের দৃষ্টির অবনতি হতে থাকে, আমাদের হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা দেখা দেয়, এবং অনেকেরই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সমস্যা দেখা দেয়। এখন আমি যদি বলি শুধু একটি মাত্র পরিপোষকের (nutrient) অভাবে এই সমস্যাগুলি হতে পারে তাহ’লে কি আপনি বিশ্বাস করবেন? তাহ’লে আসুন ওমেগা-৩ সম্বন্ধে জানতে চেষ্টা করি।
 
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড কি? 
ওমেগা-৩ একটি অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড। ওমেগা-৩ হচ্ছে এক ধরনের চর্বি (fatty acid) যা আমাদের শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। আমাদের শরীর ওমেগা-৩ উৎপাদন করে না তাই এটা আমাদের খাদ্য থেকে নিতে হবে। ওমেগা-৩ একটি পলিআনস্যচুরেটেড ফ্যাট। ওমেগা-৩ জীবকোষের পর্দার জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় পরিপোষক। এই ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় তৈলাক্ত মাছ, তিসির বীজ এবং মাছের তেলের সাপ্লিমেন্টে।
 
সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ৩ প্রকার ওমেগা-৩ হচ্ছেঃ
১। আলফা লিনোলিক এসিড (এএলএ) (alpha-linolenic acid ALA)
২। ডকোস্যহেক্সানোইক এসিড (ডিএইচএ) (docosahexaenoic acid DHA)
৩। আইকোস্যাপেন্টেনোইক এসিড (ইপিএ) (eicosapentaenoic acid EPA) 
এএলএ পাওয়া যায় উদ্ভিদজাত তেল, যেমন তিসির বীজ, সয়বীন এবং ক্যানোলা তেলে। 
ডিএইচএ এবং ইপিএ পাওয়া যাবে মাছ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্যে। এখন দেখা যাক ওমেগা-৩ কি কি উপায়ে আমাদের শরীরকে সুস্থ্য রাখতে পারেঃ 
 
১। ওমেগা-৩ বিষন্নতা ও উদ্বেগ রোধ করতে পারে
গবেষণায় দেখা গেছে যারা প্রতিনিয়ত ওমেগা-৩ খান তাঁদের বিষণ্ণতায় ভোগার সম্ভাবনা কম। গবেষণায় আরো দেখা গেছে যা বিষণ্ণতাগ্রস্ত মানুষ যারা ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট খেয়েছেন তাঁদের মানসিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
 
২। ওমেগা-৩ দৃষ্টিশক্তির উন্নয়ন করে
DHA ওমেগা-৩ হচ্ছে আমাদের চোখের রেটিনার প্রধান কাঠামোগত উপাদান। আপনার খাদ্যে যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে DHA থাকে না তখন চোখের সমস্যা দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে পর্যাপ্ত ওমেগা-৩ শরীরে থাকলে তা আমাদের চোখকে ম্যাকুলার ডিজেনারেশান (macular degeneration) নামের বার্ধক্যজনিত চোখের রোগ থেকে রক্ষা করে।
 
৩। ওমেগা-৩ গর্ভাবস্থায় ও শিশুকালে মস্তিষ্কের উন্নয়ন করে 
আপনার মস্তিষ্কের ৪০% ও চোখের রেটিনার ৬০% পলিআনস্যচুরেটেড ফ্যাট হচ্ছে ডিএইচএ। গবেষণায় দেখা গেছে যেসব শিশুকে DHA যুক্ত দুধ দেয়া হয় তাদের দৃষ্টিশক্তি অন্যান্য শিশুর তুলনা ভাল হয়। মায়েরা গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ওমেগা-৩ খেলে তা শিশুর স্বাস্থ্যের অনেক উপকার করে যেমনঃ
• বেশী বুদ্ধিমত্তা
• সামাজিক মেলামেশায় ভাল
• বিলম্বিত বিকাশের ঝুঁকি কম
• অটিজম, এ ডি এইচ ডি (ADHD) ও সেরিব্রাল পালসি’র ঝুঁকি কম
 
৪। ওমেগা-৩ হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
প্রায় ৩০ বছর আগের এক গবেষণায় দেখা যায় গ্রীনল্যান্ডের এস্কিমোদের মধ্যে হৃদরোগ খুবই কম। এর কারণ হচ্ছে এস্কিমোরা মাছ বেশী খায়। ওমেগা-৩ ট্রিগ্লিসারাইডের মাত্রা কমায়, উচ্চ রক্তচাপ কমায়, এবং ভাল কোলেস্টেরলের (এইচডিএল) মাত্রা বাড়ায়।
 
৫। ওমেগা-৩ শিশুদের এটেনশান ডেফিসিট হাইপার এক্টিভিটি ডিসর্ডার (ADHD) কমাতে সাহায্য করে
এটেনশান ডেফিসিট হাইপার এক্টিভিটি ডিসর্ডার (ADHD) একটি আচরণগত ব্যাধি যা পড়ালেখা বা কাজে মনোযোগ দিতে বাধা দেয়। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যেসব শিশুর ADHD আছে তাদের রক্তে ওমেগা-৩ এর মাত্রা সুস্থ শিশুদের তুলনায় কম।
 
৬। ওমেগা-৩ মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন করে
মানসিক রোগীদের রক্তে ওমেগা-৩ এর মাত্রা কম থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট খেলে তা স্কিৎযোফ্রেনিয়া এবং বাইপোলার ডিসর্ডার রোগীদের অবস্থার উন্নতি করে। নিয়মিত ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট খেলে তা মানুষের মাঝে হিংসাত্মক আচরণ কমায়।
 
৭। ওমেগা-৩ বার্ধক্যজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতা ও আলযহাইমার্স রোগ রোধ করে 
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে ওমেগা-৩ বার্ধক্যজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতা ও আলযহাইমার্স রোগ রোধ করে। একটি গবেষণায় দেখা যায় ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট আলযহাইমার্স রোগ রোধ করে যখন এই রোগের সামান্য উপসর্গ দেখা দেয়। 
 
৮। ওমেগা-৩ ক্যান্সার রোধ করে
বহু যুগ ধরে ক্যান্সার রোধে ওমেগা-৩ এর ভূমিকার কথা গবেষকরা জেনে আসছে। গবেষণায় দেখা গেছে যারা সবচেয়ে বেশে পরিমাণে ওমেগা-৩ খান তাদের মলাশয়ের ক্যান্সারের (কোলন ক্যান্সার) ঝুঁকি ৫৫% কম। এছারা ওমেগা-৩ পুরুষদের প্রস্টেট ক্যান্সার ও নারীদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে। ৬
 
৯। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড শিশুদের এযমা কমায়
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে ওমেগা-৩ খেলে শিশুদের এযমা হওয়ার ঝুঁকি কমে।
 
১০। ওমেগা-৩ ফ্যাটি লিভার ভাল করে
ফ্যাটি লিভার আমাদের দেশ এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশে খুব স্বাভাবিক। এটার কারণ এসব দেশের মানুষ বেশী পরিমাণে ভাত খায়। এটার প্রাদুর্ভাব পশ্চিমা বিশ্বেও বেশী। গবেষণায় দেখা গেছে ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট নিলে লিভারে চর্বির পরিমাণ অনেক কমে এবং যকৃতে প্রদাহ কমায়। 
 
১১। ওমেগা-৩ হাড় ও জয়েন্ট ভাল রাখে
হাড়ের রোগের মধ্যে অস্টিওপরোসিস এবং আর্থ্রাইটিসের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশী। ওমেগা-৩ খেলে তা হাড়ের ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ও হাড়কে রাখে মজবুত; যার ফলে অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি কমে। ওমেগা-৩ আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায়ও ব্যবহার করা যেতে পারে।
 
১২। ওমেগা-৩ মাসিকজনিত ব্যথা কমায়
অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে যেসব মহিলা সবচেয়ে বেশী ওমেগা-৩ খান তাদের তলপেটে মাসিকজনিত ব্যথা কম হয়। এমনকি, একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে মাসিকের সময় ব্যথা নিরাময়ের জন্য ওমেগা-৩ অন্যান্য ঔষধে (pain killer) চেয়ে বেশী কার্যকরি। 
 
১৩। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ঘুম ভাল হতে সাহায্য করে 
ভাল স্বাস্থ্যের জন্য ভাল ঘুম অত্যাবশ্যক। গবেষণায় দেখা গেছে ভাল ঘুমের অভাবে অতি স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও বিষণ্ণতার মত রোগ হতে পারে। শিশুদের ভাল ঘুম না হওয়া ও প্রাপ্তবয়স্কদের অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ এপনিয়ার সাথে রক্তে কম মাত্রায় ওমেগা-৩ এর একটি যোগসূত্র আছে।
 
১৪। ওমেগা-৩ ত্বক সুন্দর রাখে 
ডিএইচএ আমাদের ত্বকের কাঠামোগত একটি উপাদান। এটা কোষের পর্দা ভাল রাখতে সাহায্য করে। কোষের পর্দা ভাল থাকলে ত্বক মসৃন, নরম হয় ও ত্বকে বলিরেখা হয় না। 
 
পরিশেষে
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই দরকারি। ওমেগা-৩ পাওয়ার সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে সপ্তাহে অন্ততঃ দু’দিন তৈলাক্ত মাছ খাওয়া। কিন্তু, আপনি যদি সবসময় মাছ খেতে পছন্দ না করেন, তাহলে ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট নিতে পারেন। এটা শরীরে ওমেগা-৩ ঘাটতি দূর করার সবচেয়ে সস্তা এবং কার্যকরি উপায়। ওমেগা-৩ পাওয়া যাবে মাছ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্যে, উদ্ভিদজাত তেল, যেমন তিসির বীজ, সয়বীন এবং ক্যানোলা তেলে।
 
লেখক: খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক 
 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK