বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ২২:০৬

মাছে-ভাতে বাঙালির প্রিয় স্বাস্থ্যগুণে ভরপুর ইলিশ মাছ – ৯ উপকারিতা

মাছে-ভাতে বাঙালির প্রিয়  স্বাস্থ্যগুণে ভরপুর ইলিশ মাছ – ৯ উপকারিতা

সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ 
 
ইলিশ মাছ, যার বৈজ্ঞানিক নাম টেনুয়ালোসা ইলিশা (Tenualosa ilisha), আমাদের জাতীয় মাছ। যদিও ইলিশ লবণাক্ত পানির মাছ, এবং বেশিরভাগ সময় সে সাগরে থাকে, বংশবিস্তারের জন্য এই মাছটি প্রায় ১২০০ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে ভারতীয় উপমহাদেশের নদীগুলিতে পাড়ি জমায়। বিশ্বে মোট ইলিশ উৎপাদনের ৬৫% ভাগ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে, তাই ২০১৭-এ বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর মানে ইলিশ মাছ এখন সারা বিশ্বে বাংলাদেশী পণ্য হিসেবে বিবেচিত। 
 
এখন দেখা যাক আমাদের প্রিয় রূপালী এই মাছটিতে কি কি স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে। অন্যান্য অনেক মাছের মতই ইলিশ মাছেও আছে অনেক পুষ্টিগুণ। এই তৈলাক্ত মাছটি ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডে ভরপুর। ১০০ গ্রাম ইলিশে আছেঃ
• ৩১০ ক্যালরি
• ২৫ গ্রাম আমিষ
• ২৪ গ্রাম স্বাস্থ্যকর চর্বি 
• ৩.২৯ গ্রাম শর্করা 
• ২০৪ মিলিগ্রাম ক্যালশিয়াম 
• ২.৩৮ মিলিগ্রাম আয়রন, এবং 
• প্রতিদিনের চাহিদার ২৭% ভিটামিন সি 
 
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড কোলেস্টেরল এবং ইন্সুলিন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ইলিশ মাছের চর্বি  আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট (unsaturated fat) তাই এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিদিন ১০০ গ্রাম ইলিশ খেলে খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) কমাতে এবং ভাল কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বাড়াতে সাহায্য করে।  অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে ইলিশ মাছ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। এখানে ইলিশ মাছের ৬টি স্বাস্থ্যগুণ এবং ইলিশ মাছের ডিমের ৩টি উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করব। নীচে ক্লিক করে পরের পৃষ্ঠায় প্রবেশ করুন।   
 
১। ইলিশ মাছ ত্বক সুন্দর রাখে 
ইলিশ মাছে আছে প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, যা আমাদের ত্বক ভাল রাখতে সাহায্য করে। আর শরীরে ওমেগা-৩ কম থাকলে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। ওমেগা-৩ প্রদাহ এবং একনি কমায়।  সাম্প্রতিককালের বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে ত্বকের সৌন্দর্য ও ত্বকের স্বাস্থ্য নির্ভর করে কি ধরনের খাদ্য আমরা খাই।  “এটা অবশ্যই সত্য যে ত্বকের স্বাস্থ্যের উপর খাদ্য একটি প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখে। সঠিক খাদ্য শুধু ত্বক কুঁচকানোই রোধ করে না, এটা ব্রণ, একজিমা এবং সোরাইসিসের মত সমস্যাও দূর করে,” বলেন বায়োকেমিস্ট ও চর্ম বিশেষজ্ঞ ডক্টর ইলেইন লিঙ্কার।
 
২। ইলিশ মাছ হৃদপিন্ডের জন্য ভাল  
নিয়মিত ইলিশ মাছ খেলে তা আমাদের হার্টের স্বাস্থ্য ভাল রাখে এবং হৃদরোগ থেকে আমাদের দূরে রাখে। এটার কারণ এই মাছে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। ১০০ গ্রাম ইলিশে প্রায় ২১.৮ গ্রাম প্রোটিনের পাশাপাশি রয়েছে উচ্চ পরিমাণে ওমেগা-৩, নায়াসিন, ট্রিপ্টোফ্যান, ভাইটামিন বি ১২, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম সহ অন্যান্য ভাইটামিন ও মিনারেল। বিশেষজ্ঞদের মতে সপ্তাহে একবার ইলিশ খেলে তা হৃদপিন্ড সুস্থ রাখবে। এছাড়া ইলিশ রক্তনালির স্বাস্থ্য রাক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 
 
৩। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য
প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড Essential Fatty Acid (EFA) আমাদের শরীর তৈরী করে না তাই এটা খাদ্য থেকে নিতে হয়। EFA-এর মধ্যে সবচেয়ে উপকারি হচ্ছে ওমেগা-৩। গবেষণায় দেখা গেছে শরীরে ওমেগা-৩ কম থাকলে স্মৃতিভ্রম এবং আলযহাইমার্স রোগ (Alzheimer's disease) হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সঠিকভাবে কাজ করতে আমাদের মস্তিষ্কের প্রয়োজন ভাল পরিপোষক। ইলিশ মাছে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড মস্তিষ্কের কোষ জন্মাতে ও মেরামত করতে সাহায্য করে এবং এই মাছের এন্টি অক্সিডেন্ট মস্তিষ্কের কোষের প্রদাহ কমায়। 
 
৪। রুমাটয়েড আর্থ্রাইটিস 
নিয়মিত ইলিশ মাছ খেলে রুমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (বাত) হওয়ার ঝুঁকি এবং জয়েন্টের ব্যাথা কমে। এটার কারণ এই মাছ শরীরে প্রদাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। গবেষণায় দেখা গেছে যারা প্রতিনিয়ত উচ্চ পরিমাণে ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ খান তাদের রুমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। এবং যারা ইতিমধ্যেই এই রোগে আক্রান্ত, মাছের ওমেগা-৩ তাদের জয়েন্ট ফোলা ও বাতের ব্যথা দূর করবে। 
 
৫। রক্তচাপ
গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিতি ইলিশ খেলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে। উচ্চ রক্তচাপ ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোনো প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায় না। নীরবে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ইলিশ একটি তৈলাক্ত মাছ, তাই এতে আছে প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাটি। এই ওমেগা-৩ উচ্চ রক্তচাপ নামিয়ে আনতে, প্রদাহ কমাতে এবং রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া ইলিশ মাছের অন্যান্য পরিপোষক হৃদপিন্ডের জন্য ভাল। 
 
৬। দৃষ্টিশক্তি
ইলিশ মাছে আছে প্রচুর ভাইটামিন এ যা দৃষ্টীশক্তি ভাল রাখতে এবং বার্ধক্যজনিত দৃষ্টিহীনতার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। শুধু ইলিশ নয়, যে কোন মাছই দৃষ্টিশক্তির জন্য ভাল। মাছের ওমেগা-৩ চোখের ছানি, চোখ শুকিয়ে থাকা (dry eye syndrome) এবং ম্যাকুলার ডিজেনারেশান (macular degeneration) রোধ করে। ওমেগা-৩ একটি স্বাস্থ্যকর চর্বি এবং এটা দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে ও চোখের রেটিনা সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। আপনি যদি মাছ খেতে পছন্দ না করেন তাহলে ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট নিতে পারেন। 
 
ইলিশ মাছের ডিমের উপকারিতা  
বিজ্ঞানীদের মতে, আপনি যদি ওজন কমাতে ও খাদ্যাভ্যাসের উন্নতি করতে চান তাহলে আপনার উচিৎ মাছের ডিম খাওয়া। মাছে থাকা শর্করার পরিমাণ নির্ভর করে মাছের উপর, তবে ইলিশ মাছের ডিমে আছে খুবই কম শর্করা। ইলিশ মাছের ডিমের আরো ৩টি উপকারিতা নীচে দেয়া হলঃ
1. ইলিশ মাছের ডিমের ভাইটামিন ডি দাঁত ভাল রাখতে সাহায্য করে
2. এই মাছের ডিমে থাকা ভাইটামিন ডি হাড় শক্ত রাখে
3. মাছের ডিম খেলে হিমোগ্লোবিন বাড়ে ফলে এনিমিয়া হওয়ার ঝুঁকি কমে
 
পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া
গর্ভবতী মায়েদের উচিৎ ইলিশ মাছসহ অন্যান্য মাছ না খাওয়া কারণ এগুলোতে আছে সামুদ্রিক ডাই অক্সিন, মার্কারি এবং অন্যান্য পদার্থ। 
 
পরিশেষে 
মাছ পৃথিবীতে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্যের মধ্যে একটি। মাছে আছে প্রচুর পরিমাণে নিউট্রিয়েন্ট, স্বাস্থ্যকর আমিষ ও ভাইটামিন ডি। এছাড়া ইলিশ মাছের মত তৈলাক্ত মাছে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড আপনার শরীর ও মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারি। তাই চেষ্টা করুন বেশী বেশী মাছ খেতে, ইলিশ হোক বা যে কোন তৈলাক্ত মাছই হোক। সপ্তাহে অন্ততঃ একদিন মাছ খাওয়া উচিৎ, বিশেষজ্ঞদের মতে।
 
লেখক: খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক  
 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK