শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০৯:১০
ব্রেকিং নিউজ

ওপারে ভালো থেকো বাবা

ওপারে ভালো থেকো বাবা

অনিমেশ কুন্ডু
 
আস্থা, ভরসা আর পরম নির্ভরতার নাম ‘বাবা’। বাবা মানে একটু শাসন, অনেক ভালোবাসা। বাবা এমন এক বৃক্ষ, যে বৃক্ষের ছায়ায় বেঁচে থাকার শক্তি পায় সন্তান। যে কোনো পুরুষই বাবা হতে পারে তবে প্রকৃত বাবা হতে কিছুটা বিশেষত্ব দরকার। আমার বাবার সেই বিশেষত্ব ছিল। আমার বাবা বহুগুণেই গুণান্বিত ছিলেন। আমরা দুই ভাইবোন। অনিমেশ ও অমিতি। বাবার ভেতরটায় যে আমাদের দুজনের জন্য নিখাদ ভালোবাসায় পূর্ণ ছিল, তা আমরা সবসময় প্রত্যক্ষ করেছি। এখনো করছি অদৃশ্য ছায়ায়। তাই বাবাহীন প্রতিটি দিন একাকিত্ব আমার। একজন সাধারণের মতোই জীবনযাপন ছিল তাঁর। ব্যক্তিজীবনে আদিখ্যেতা কিংবা অহংবোধ তাঁকে স্পর্শ করেনি কখনো। সংগ্রামমুখী তাঁর জীবনকর্ম। মানবিক হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন আমার বাবা। এই মানবিকতাই তাঁকে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত করেছে। আমার কর্মময় জীবনেও তাঁর এই মানবিকতার ছায়া পড়েছে। আমার কাছে তিনি তার কীর্তির চেয়েও মহৎ ছিলেন। বাবা সব সময় বলতেন পরিশ্রমের বিকল্প হয় না। তুমি প্রতিভাবান মেধাবী হতে পার; কিন্তু পরিশ্রম না করলে সৃজনশীল কাজ করা যায় না। বলতেন, সৃষ্টির যন্ত্রণা না থাকলে সৃজনশীল কাজ হয় না। কাজ করা যায় না। বাবা ছিলেন কাজপাগল মানুষ। কাজের মধ্যেই তিনি নিজের তৃপ্তি খুঁজে পেতেন। কাজের পরিপূর্ণতার মধ্যেই সফলতা খুঁজেছেন। তিনি বিনয়ী, মৃদুভাষী ও বন্ধুসুলভ ছিলেন। মানুষের উপকার করতেন এবং কেউ তাঁর উপকার করলে সেটা ভুলতেন না। প্রয়োজনে প্রতিদান দিতে চেষ্টা করতেন।
 
শিল্পীসত্তাই তাঁর মুখ্য পরিচয়। ষাটের দশকে এদেশের চিত্রকলায় নতুনমাত্রা সঞ্চার করেছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে স্বীয় প্রতিভা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছিলেন সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। আমার বাবার মূল্যায়ন- কারও কাছে তিনি শিল্পী, কারও কাছে ভাস্কর, কারও কাছে শিল্পোদ্যোক্তা। তিনি খুব মিশুক প্রকৃতির লোক ছিলেন। সহজেই সবাইকে আপন করে নিতেন। বাবাকে নিয়ে আমার যত কথা, যত স্মৃতি, তা কয়েকটি বাক্যে সমন্বয় সম্ভব নয়। প্রতিমুহূর্তের কর্মে বাবা আমার ছায়াসঙ্গী। ২০০৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে যান তিনি। দেখতে দেখতে ১৫টি বছর পেরিয়েছে। 
১৯৭১ সাল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মার্কিনিরা পাকিস্তানের পক্ষ নিলে বাবা তাঁর মার্কিন দূতাবাসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কাজ করতেন জনসংযোগ বিভাগে। সেসময় বাবার আঁকা একটি পোস্টার মুক্তিকামী মানুষের মনে ব্যাপক সারা ফেলে। পোস্টারের বক্তব্য ছিল- ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিযোদ্ধা’।
 
আরেকটি পোস্টারের বক্তব্যও সেসময় বেশ আলোচিত ছিল-‘বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান আমরা সবাই বাঙালি’। পরে এই বক্তব্যটি সুরারোপিতও হয়। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলার মানুষকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার জন্য বহু পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন আঁকেন, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিশেষ অস্ত্র।
 
মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁর সংগ্রাম ছিল মূলত জীবনযুদ্ধ। জীবনের প্রতিটি স্তরেই তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে। লড়াইটা নিজেকে গড়ার মধ্য দিয়ে দেশকে গড়া। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিটপি থেকে বেরিয়ে মাত্র ৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে রাজধানীর শুক্রাবাদে একটি ওয়ার্কশপ খুলেন। সময়টা ১৯৭৫ সাল। বাবার কাজের শুরুটা হয়েছিল ঘর সাজানোর পণ্য দিয়ে। এই ক্ষেত্রে চারুকলাভিত্তিক কনসেপ্ট তাঁর মাথায় কাজ করেছিল। তারপর আজকের অটবি। এই ক্ষেত্রে গৃহস্থ আসবাবপত্র, গৃহসজ্জার নতুন ধরনের পণ্য-যার প্রতিটির মধ্যে ছিল শৈল্পিক তথা নান্দিকতার ছাপ। কাজের কোয়ালিটি ধরে রাখতে যা যা প্রয়োজন তিনি তাই করতেন। প্রয়োজনে ভেঙে নতুন করে তৈরি করতেন। সেখানে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে তা মেনে নিতেন। কিন্তু নিজের বিবেকের সঙ্গে আপস করতেন না।
 
একজন শিল্পী কীভাবে শিল্পোদ্যোক্তা-এই প্রশ্নটি আমার মনেও ছায়া ফেলত। বাবা তাঁর কোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘দৈনন্দিন জাগতিক প্রয়োজনের নাগপাশের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে, আহার-বাসস্থানের দুশ্চিন্তার বাইরে বেরিয়ে গিয়ে শিল্পী যাতে তার পরিপূর্ণ শক্তি পরিপূর্ণ উদ্যম কেন্দ্রীভ‚ত করতে পারেন শিল্পের ওপরে- সেই উদ্দেশ্যেই আমার শিল্পোদ্যম।’ তাঁর এই বক্তব্যের মাঝেই আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই। প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করছি- চারুকলা থেকে ভালো ফল করে বের হওয়ার পর তাঁর স্বপ্ন ছিল স্বীয় বিভাগের শিক্ষক হবেন। সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও অদৃশ্য কারণে হতে পারেননি। এই তাঁর আক্ষেপ ছিল; কিন্তু বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছিলেন শেষপর্যন্ত। এই আক্ষেপই তাঁকে কর্মোদ্যোগী এবং আজকের অবস্থানে আসতে সহায়তা করেছে।
 
স্বাধীন বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পচর্চার সূচনাপর্বে বাবাও সম্পৃক্ত ছিলেন। শিল্পী আবদুর রাজ্জাক, আব্দুল্লাহ খালিদ, মৃণাল হক এবং শামীম সিকদারের পাশাপাশি বাবার নামটিও বেশ আলোচিত ছিল। ঢাকায় সোনারগাঁও হোটেলের সামনে ‘সার্ক ফোয়ারা’, রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য ‘সাবাশ বাংলাদেশ’, চট্টগ্রাম বন্দরে ঐতিহ্যবাহী নৌকার প্রতীক ‘সাম্পান’। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘কদমফুল’, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের সামনের ফোয়ারাসহ বহু শিল্পকর্ম ও ভাস্কর্য নিমার্ণ আমার বাবার হাতেগড়া। প্রতিটি কর্মসম্পাদনের পেছনে রয়েছে নানামুখী ইতিহাস। এই লেখায় এর কিছু আলোপাত করতে চাই। 
সাবাশ বাংলাদেশ তৈরির পূর্বে বাবা ভারতে গিয়েছিলেন সেখানকার বিখ্যাত ভাস্কর চিন্তামণি করের সঙ্গে পরামর্শ করতে। প্রস্তাব শুনে ভাস্কর চিন্তামণি কর বিস্মিত হয়েছিলেন। কারণ, বাবা একজন চিত্রশিল্পী। কালি, কাগজ ও রংতুলি নিয়ে তাঁর কাজ। সে কি করে ইট, পাথর, সিমেন্ট ও লোহার মাধ্যমে ভাস্করের কাজ করবেÑএটা তাঁর মাথায় আসেনি। পরে বাবার কাছে শুনেছি, রাজশাহীতে ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ শীর্ষক ভাস্কর্যটি শেষ হলে বাবাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন চিন্তামণি।
 
সৌন্দর্যের প্রতীক সার্ক ফোয়ারা নির্মাণ নিয়েও রয়েছে এক অজানা অধ্যায়। ’৯২ সালে যখন এটির নির্মাণকাজ তাঁকে দেওয়া হয়, এর আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে চলে নানা টালবাহানা। কাজটি তাঁকে দিয়ে না করানোর জন্য অনেকেই সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করে। বাবার হাতে কাজটা চলে আসার পর থেকে কয়েকজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা কিছু অনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করেন। এদের মধ্যে রাজউকের একজন প্রকৌশলীও ছিলেন। এই প্রসঙ্গে বাবা একটু মজা করে বলেছিলেন, কাজটি খুব দ্রুত করতে গিয়ে দিনরাত আমাকে কাজ করতে হতো। একদিন রাতে একজন সিনিয়র মন্ত্রী এলেন। আমাকে ডাকলেন। বললেন, আপনি কি কন্ট্রাকটর। বাবা হাসতে হাসতে বললেন, শিল্পী আর কন্ডাকটরের পার্থক্য কি তা দেশের একজন সিনিয়র মন্ত্রীও বুঝেন না। এখানে বলা প্রয়োজন, এটি করতে সময় দরকার ছিল কমপক্ষে ৬ মাস। তাকে দেওয়া হয়েছিল মাত্র ২৮ দিন।
 
বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সমুদ্র উপক‚লের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকার একেবারে সম্মুখে তৈরি করা হয়েছে এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য ‘সাম্পান’। এটি স্থাপত্যরীতির জ্যামিতিক কাঠামোয় বিন্যস্ত। অনুজ্জ্বল সাদা রঙের ব্যবহার এটিকে করেছে অসাধারণ মোহময়। এই ভাস্কর্যটির পটভ‚মি আধুনিক স্থাপত্য কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। এই ভাস্কর্যটিতে শিল্পী ও শিল্পীসত্তার এক অপূর্ব নান্দনিকতার প্রকাশ রয়েছে। চট্টগ্রামে মাটি ও মানুষের ঐতিহ্যের প্রতীক এটি।
 
অনেকের কাছেই আমার বাবা আর অটবি অনেকটা সমার্থক। কারণও হয়তো রয়েছে, অটবির সর্বাঙ্গেই তিনি ছড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশে ইম্পোর্টেড ফার্নিচারের ভিড়েও তিনি পেরেছিলেন অটবির সব প্রোডাক্টকে কম্পিটিটিভ রাখতে। এজন্য তিনি কোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় সহানুভ‚তি চাননি। অটবি প্রজেক্টকে তিনি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রেখেই বাজারজাত করেছিলেন। অটবির বড়ো সাফল্য এখানেই। সন্তানদের মতোই তিনি অটবিকে ভালোবাসতেন। অফিসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী তাঁর কাছে সন্তানতুল্য। তাঁদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকতেন।
 
অনিমেশ কুন্ডু
 
নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে আমাদের এক কর্মচারীর মেয়ে অপহরণ হয়। বাবা এই ব্যাপারে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তৎকালীন আইজিকে ফোন করে সহযোগিতা চান। সেবার পুলিশের তৎপরতায় মেয়েটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার হয়। বাবার এই ধরনের মানবিক কর্মকাণ্ডকে আমি অনুসরণ করার চেষ্টা করি।
 
মৃত্যুর আগে অটবির দায়িত্বভার আমাদের ভাইবোনদের মাঝে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তার বন্ধুদের বলেছিলেন, আবার ফিরে আসব শিল্পচর্চায়। তিনি ফিরেছিলেনও। কিন্তু সময় তাঁকে সেভাবে ফিরতে দেয়নি। আমি মনে করি, তিনি শিল্পী ছিলেন। তিনি শিল্পী হিসেবেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কখনো সক্রিয় রাজনীতি করেননি। তবে আমরা দেখেছি রাজনীতির সঙ্গেই তাঁর ওঠবস ছিল। দেখেছি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংস্থার অঙ্গসংগঠনের কর্মকাণ্ড যেমন: মঞ্চসজ্জা, নাটকের সেট, সম্মেলনের মঞ্চ, পোস্টার, ব্যানার, স্লোগানে তাঁর সহযোগিতা ছিল। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বামপন্থি ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারাতেই সহমত পোষণ করতেন সব সময়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের পরিধি ব্যাপ্তি ছিল। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁকে জানতেন বলে শুনেছি। আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
 
এখন আমি যে কোন সৃজনশীল কাজে হাত দিতেই বাবাকে মনে পড়ে। মনে হয় তিনি আমাকে লক্ষ্য করছেন। এই মাত্র বলবেন, এটা ওভাবে না বাবু। দীর্ঘ ১৫ বছর পরম স্নেহে আমাকে কেউ বাবু বলে ডাকে না। বাবা তোমার অনেক স্মৃতি, অনেক কথা আজও ভুলতে পারিনি, ভোলা যায় না। তুমি না থাকলেও তোমার স্মৃতি আমার কাছে চিরঅম্লান। আমার সাহস এবং অনুপ্রেরণা এখনও তুমি। বাবা তুমি তোমার কর্মেই বেঁচে আছো, বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। থাকবে আমাদের কাছাকাছি। ওপারে ভালো থেকো বাবা।
 
লেখক : প্রয়াত নিতুন কুন্ডুর ছেলে 

 

 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK