শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০৪:৩১
ব্রেকিং নিউজ

লুঙ্গিতে ঐতিহ্য

লুঙ্গিতে ঐতিহ্য

উত্তরণবার্তা প্রতিবেদক : ঢাকার দোহার উপজেলায় হাতে বুনন করা লুঙ্গি ঐতিহ্য বহন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। এখানকার তাঁতীদের উৎপাদিত লুঙ্গি কেবল আরামদায়কই নয়, টেকসইও বটে! যে কারণে নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এক রকম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে টিকে আছে এ শিল্পটি। নান্দনিক নকশার মাধ্যমে অন্যান্য পোশাকে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হলেও এখন পর্যন্ত দোহারের তৈরি লুঙ্গিতে কোনো নকশা কিংবা প্রিন্টের কাজ হয়নি। তবে একথা সত্য যে, রঙ-বেরঙের সুতার বুননে সহজেই হয়ে উঠে পরিচ্ছন্ন একটি লুঙ্গি।

আমাদের দেশে অনেক এলাকাতেই অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করে দেশীয় ও তাঁতের সাহায্যে বুনানো লুঙ্গি তৈরি হলেও বুনন ও বৈচিত্র্যের জন্য দোহার উপজেলার তাঁতীদের হাতের সাহায্যে বুনানো লুঙ্গির কদর সারা দেশে। সূক্ষ্ম সুতার সাহায্যে বুননই দোহারের লুঙ্গির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জানা যায়, আজ থেকে প্রায় দুইশ বছর আগে জীবন-জীবিকার তাগিদে খুব ভালোভাবেই গোড়াপাত্তন হয়েছিল এই শিল্পের। উপজেলার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ লোক সরাসরি এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। দেশ স্বাধীনের আগে এ শিল্পের স্বর্ণযুগ ছিল।

বিদেশি পোশাকের আগ্রাসন ও মেশিনের সাহায্যে দেশে লুঙ্গি উৎপাদন শুরু হলে '৮০-এর দশকে থেকে স্থানীয় লুঙ্গির চাহিদা কমতে থাকে। মেশিনের সাহায্যে তৈরি লুঙ্গি কম দাম হওয়ায় মানুষজন ওদিকেই ঝুঁকতে থাকে। কিন্তু গুণাগুণের দিক বিবেচনা করলে হাতের সাহায্যে বুনানো লুঙ্গি সবদিক থেকেই উন্নত। যে কারণে রুচিশীল মানুষের কাছে প্রথম পছন্দ দোহারের তাঁতের সাহায্যে বুনানো লুঙ্গি।

নিকট অতীতেও দোহার উপজেলার সব ইউনিয়নে লুঙ্গি তৈরির কাজ হতো।এখন জয়পাড়া ও রাইপাড়া এ দুটি ইউনিয়নে  তাঁতের কাজ চলছে। এ সম্প্রদায়ের লোকজন এ কাজ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর কারণে শ্রমিকের অভাবে মারাত্মক হুমকির  মধ্যে পড়ে এ শিল্পটি। সেই থেকে শ্রমিকের সমস্যা রয়েই গেছে, পুরোপুরি  শ্রমিরনির্ভর হওয়ায় আগের মতো লাভ হয় না তাঁতীদের। এছাড়া উৎপাদিত লুঙ্গির নিয়মিত হাট বসত শিবরাপুর ও জয়পাড়ায়। এখন সেই হাটও আগের মতো জমজমাট নেই। যার দরুন লুঙ্গি ব্যবসায়ীদের কাজ থেকে অর্ডার পাওয়ার পর লুঙ্গি তৈরি হয়ে থাকে।
 
নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অতীত ঐহিত্যকে ধরে রেখেছেন এখানকার তাঁতীরা। এক সময় বিখ্যাত মসলিন কাপড় তৈরি হতো এই দোহারের জয়পাড়া ও মালিকান্দা এলাকায়। সময়ের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে হারিয়ে গেছে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ মসলিন কাপড়। জয়পাড়ার প্রতিষ্ঠিত লুঙ্গির ব্যবসায়ী মো. মজিরব বেপারী। তিনি নিজ বাড়িতে মাসিক চুক্তিতে বেশ কয়েকজন কারিগর দিয়ে তাঁত চালু রেখে লুঙ্গি উৎপাদন করছেন। আবার স্থানীয় তাঁতীদের কাছ থেকে নায্যমূল্যে লুঙ্গি কিনে বিক্রি করছেন নামিদামি প্রতিষ্ঠানের কাছে।

মজিবর বেপারী জানান, দোহারে এক সময় কেবল পরিবারের সব সদস্যদের সহযোগিতায় উৎপাদিত হতো লুঙ্গি। এখন তাঁতী পরিবারের লোকজন এ কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় নিযুক্তি হওয়ায় হুমকির মধ্যে পড়েছে শিল্পটি। পুরোপুরি বাইরের শ্রমিকের ওপর নির্ভর এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে উঠেছে। টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করা না গেলে হারিয়ে যাবে এ শিল্প। আব্দুল বাছের নামে এক তাঁতী জানান, আমানত শাহ লুঙ্গির প্রতিষ্ঠান আমাদের এলাকা থেকে লুঙ্গি সংগ্রহ করার কারণে এখনো আগ্রহ হারানটি তাঁতীরা, যার জন্য  টিকে থেকে খেয়েপড়ে বেঁচে আছেন এখানকার তাঁতীরা। যদি এ ধরনের প্রতিষ্ঠান না থাকতো তাহলে আরও আগেই বন্ধ হয়ে যেত এ শিল্প।

চর জয়পাড়া এলাকার মো. রফিক নামের একজন প্রান্তিক তাঁতী বলেন,  বর্তমানে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিরাজগঞ্জ ও পাবনা থেকে মেশিনে তৈরি লুঙ্গি কিনে এনে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জয়পাড়ার লুঙ্গি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। এতে একদিকে যেমন ক্রেতারা ঠকছেন অন্যদিকে সুনাম হারাচ্ছে জয়পাড়ার লুঙ্গি। তবে দোহারের লুঙ্গি ব্যবসায়ীদের পরামর্শ, এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন টেকসই উন্নয়ন ও সরকারের সহযোগিতা। প্রয়োজন নায্যমূল্যে শ্রমিকের সরবরাহ; সেই সাথে স্থানীয়দের এ কাজে মনোনিবেশ করা। তাহলেই যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে ঐতিহ্যবাহী  জয়পাড়ার লুঙ্গি।
উত্তরণবার্তা/এআর

 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK
আরও সংবাদ