শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ২১:৪১
ব্রেকিং নিউজ

মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রেরণাদাত্রী

মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রেরণাদাত্রী

সাইদ আহমেদ বাবু
 
প্রায় অর্ধশত বছর আগে এক বাঙালি নারী, হতেই পারেন তিনি বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের বিখ্যাত বক্তৃতাদানের আগে তার পটভূমি তৈরি করে দিচ্ছেন কী মহান রাজনৈতিক আদর্শের আত্মজিজ্ঞাসা থেকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সেদিনের সেই অলিখিত ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এজন্যই শেখ মুজিবুর রহমান আজো বাঙালির বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে, অর্থ-সম্পদ দিয়ে, সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়ে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করে স্বাধীনতার লাল সবুজের পতাকা ওড়াতে সক্ষম হয়েছিল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরে বিখ্যাত সেই ৭ মার্চ-এর ভাষণের পূর্বপরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে (বঙ্গবন্ধু কন্যার লেখা থেকে জানা) একটি আঁচড়ে উজ্জ্বল করে তুলেছেন বঙ্গবন্ধুর পত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে। তার তীক্ষ্ন বুদ্ধিতে মহৎ করেছে বালক কালের প্রবীণতাকে ধৈর্য সহকারে। প্রচণ্ড ধীশক্তি দিয়ে পরিচালনা করেছেন স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
 
১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব মন্ত্রী হলে বেগম মুজিব নম্বর মিন্টো রোডের বাড়িতে ওঠেন। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলে ১৪ দিনের নোটিসে ৩ নম্বর মিন্টো রোডের বাসা ছাড়তে বাধ্য হন বেগম মুজিব। এ রকম অনেকবার তাঁর বাসা বদল করতে হয়েছে। অবশেষে ১৯৬১ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে নিজেদের বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এবং ওই বছরের ১ অক্টোবর বেগম মুজিব ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে প্রবেশ করেন।
 
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র বিভিন্ন অংশে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখায় উঠে এসেছে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় নেতৃত্বের অনুপ্রেরণা ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশ ও মানুষের কল্যাণে অবদান রেখে গেছেন, তাকে প্রেরণা-সাহস-উৎসাহ দিয়েছেন।
 
বনানী কবরস্থানের গেটে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছাকে শ্রদ্ধা জানাতে আমরা ক’জন মুজিব সেনা
 
১৯৬২ সালের সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যখন অন্দোলন শুরু হয় তার কিছুদিন পরেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু প্রেরিত বার্তা মোতাবেক আন্দোলন পরিচালনা ও নির্দেশনা দিতেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেগম মুজিব। ১৯৬৬ সালে বাঙালির জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করে জনমত সৃষ্টির জন্য সারাদেশে জনসভা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আটবার গ্রেপ্তার হন। বঙ্গবন্ধু যখন বারবার পাকিস্তানি শাসকদের হাতে বন্দি জীবনযাপন করছিলেন, তখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী বেগম মুজিবের কাছে ছুটে আসতেন, ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাকসহ অপরাপর ছাত্রনেতার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ ছিল। আর ৬ দফা আন্দোলনের সব থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কারাবন্দিদের মুক্তির জন্য ৭ জুনের হরতাল সফল করা, সেটাও সফল হয়েছিল বেগম মুজিবের প্রচেষ্টায়। গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিকনির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাতেন।
 
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করার পর তদানীন্তন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করে গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়। নেপথ্যে থেকে তিনি ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। এই গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে সে সময় সারাদেশ আন্দোলনে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। সামরিক জান্তা আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিল আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন। আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা বঙ্গবন্ধু ভবন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সড়কে বেগম মুজিবের কাছে ছুটে যান প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য। কিন্তু বেগম মুজিব এক অনমনীয় দৃঢ় মনোভাব প্রদর্শন করেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাকে প্যারোলে মুক্তি না নেয়ার অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পাকিস্তানি শাসকের সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। ইতোমধ্যে শেখ মুজিবের মুক্তি আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। গণঅভ্যুত্থানের মুখে বেগম মুজিবের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর সেই বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের জন্য আইয়ুব খান জনরোষ থেকে বাঁচতে, ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ মেনে নিয়ে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার, স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের সেই বাড়িটি স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ- স্বাধীনতার এক অবিনশ্বর কেন্দ্র। এই অগ্নিকুণ্ডের প্রধান শক্তি বঙ্গমাতা বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সব অভিযুক্তরা একসঙ্গে নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করেন। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়।
 
১৯৭০-এর নির্বাচনের সময় বিভিন্ন দল দাবি তুলেছিল ভোটের আগে ভাত চাই। কিন্তু বেগম মুজিব আওয়ামী লীগের নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, কিন্তু পাকিস্তানিরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করে। শুরু হয়ে যায় পূর্ববাংলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব। বাঙালির স্বাধীনতা ও অধিকারের সংগ্রামে ওপরে বর্ণিত এ দুটি ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে যদি বঙ্গমাতা প্রত্যক্ষ অবদান না রাখতেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে পরিবারের অপরাপর সদস্যদের সঙ্গে ধানমন্ডির ১৮নং সড়কের একটি বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। চরম মানসিক পীড়ন ও ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। কিন্তু স্বামীর বন্দিদশা এবং পাকিস্তানের কারাগারে তাকে হত্যার আশঙ্কা সর্বোপরি নিজেদের বন্দিত্ব ও নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি মুহূর্তের জন্যও ভেঙে পড়েননি; মাথানত করেননি। ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর তাদের বন্দিদশার অবসান ঘটে। কিন্তু তারপরও বিজয়ের আনন্দ তিনি অনুভব করতে পারেননি। অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং দেশবাসীকেও ধৈর্যধারণের জন্য পরামর্শ দিতে হয়েছে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতীক্ষার। বাঙালি জাতি ফিরে পায় তাদের অবিসংবাদিত প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
 
 
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কবরে আমরা ক’জন মুজিব সেনার শ্রদ্ধাঞ্জলি 
 
এই মহীয়সী নারী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশ ও জাতির সেবা করে গেছেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেবল জাতির পিতার সহধর্মিণীই নন, বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে অন্যতম এক স্মরণীয় অনুপ্রেরণাদাত্রী। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা আজকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণের জন্য কাজ শুরু করেছেন। আমাদের স্বাধীনতার পতাকাকে বহন করে তিনি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে রোল মডেলে পরিণত করেছেন। বঙ্গমাতার ৯১তম জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
 
সাইদ আহমেদ বাবু : সভাপতি, আমরা ক’জন মুজিব সেনা ও সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য উত্তরণ।

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK