বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০২:২২
ব্রেকিং নিউজ

শেখ কামাল : তারুণ্যের দেদীপ্যমান মশাল

শেখ কামাল : তারুণ্যের দেদীপ্যমান মশাল

সাইদ আহমেদ বাবু
 
শেখ কামাল তখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে বসবাস করেন। আমাদের বাড়ি কলাবাগান হওয়াতে উনারা মূলত আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন, আর সেই সূত্রেই সখ্যতা। আমার মেজ ভাই শেখ কামালের খেলার সাথী ছিলেন।উনারা একসঙ্গে মিছিল করতেন।সে পরিচয়ে আমিও মিছিলে যেতাম।বয়সে উনি আমাদের চেয়ে অনেক বড় হলেও আমাদের সাথে মিশতেন। অসাধারণ একজন অর্গানাইজার ছিলেন।সেসময় কামাল ভাই ৩২নম্বর সড়কের মিরপুর রোডে প্রায়ই মিছিল করতেন, সেই মিছিলে হরেক রকম স্লোগানে দিয়ে আমরা আনন্দ পেতাম। একটা কথা খুব মনে আছে উনি তখন ঢাকা কলেজে পড়তেন। ১৯৬৯ এর ঘটনা তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু জেলে, তখন আমরা মিছিলে স্লোগান দিয়েছিলাম ‘জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো।’ আর নানা রকমের স্লোগান, এরকম অনেক স্মৃতি কামাল ভাইয়ের সাথে আমার। ছোট বলে খুব স্নেহ করতেন।সাথে সখ্য আরেকটি কারণ স্বাধীনতার পর কলাবাগানের মাঠে খেলাধুলা সূত্র ধরে। আজ আর ঐদিকে যাবনা, বই এবং নিজের দেখা, অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শেখ কামাল ভাই সম্পর্কে আলোচনা করব।
 
অসমাপ্ত আত্বজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-……আমি যখন জেলে যাই তখন ওর(কামালের) বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে।” (পৃ. ২০৯)। জাতির জনক তাঁর ঔরসের সন্তানদেরও কাছে পান না, এক আর্দ্র বিচ্ছিন্নতায় সমৃদ্ধ হয়। জনজীবনের জোয়ার। বারবার ফিরে আসে কারাগারের কঠোর জীবন, যে-কারাগারে তাঁকে মুক্তির অনুশীলনে আরও নিশ্চিত প্রত্যয়ে দীক্ষিত হতে হয়, ঔপনিবেশিক তৃতীয় বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপুরুষের মতো।
 
 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, পারিবারিক ত্যাগের কিছু দু:খের অথচ সহাস্য ও মধুর বর্ণনাও দিয়েছেন।ঢাকা জেল, ফরিদপুর জেল হয়ে পুলিশি পাহারায় গোপালগঞ্জ মহকুমায় নিয়ে আসা হল। মামলার আসামী হিসেবে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-‘ গোপালগঞ্জে যেয়ে দেখি থানার ঘাটে আমাদের নৌকা। আব্বা, মা, রেণু, হাসিনা ও কামালকে (পুত্র) নিয়ে হাজির।… গোপালগঞ্জ থেকে আমার বাড়ি চৌদ্দ মাইল দূর। এক বৎসর পরে আজ ওদের সাথে আমার দেখা। হাসিনা আমার গলা ধরল আর ছাড়তে চায় না। কামাল আমার দিকে চেয়ে আছে, আমাকে চেনেও না আর বুঝতে পারে না, আমি কে? মা কাঁদতে লাগল। আব্বা মাকে ধমক দিলেন এবং কাঁদতে নিষেধ করলেন’ (পৃ: ১৮৩) ১৯৫১ সালের অক্টোবরে মৌলানা ভাসানিসহ শেখ মুজিব পুনর্বার জেলে গেলেন (পৃ: ১৯৫)।
 
মুক্তি পেলেন ১৯৫২-র ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে। ততদিনে ভাষা আন্দোলনের রক্তভেজা ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটেগেছে। শেখ হাসিনা ছোট।শেখ মজিব বাড়ি পৌঁছতেই “হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, “আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।” ২১ ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে। কামাল আমার কাছে আসল না, তবে আমার দিকে চেয়ে রইল।” (পৃ: ২০৭)
 
নৈকট্যের সুত্রপাতের ছবিটিও যেন একটি জিদ্ধ কৌতুক ও করুণ রসের মিশ্রণে তৈরি— তার পরের কয়েকটি লাইনে স্বামী-স্ত্রীর বেদনাবিদ্ধ মিলনের সুন্দর একটি ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন বঙ্গবন্ধু- ‘রেণু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাঁধা ভেঙে গেছে।… বাচ্চা দুইটা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুয়ে পড়লাম। সাতাশ-আঠাশ মাস পরে আমার সেই পুরানা জায়গায়, পুরানা কামরায়, পুরানা বিছানায় শুয়ে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠের দিনগুলির মনে পড়ল’ (পৃ: ২০৭) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্যক্তিগত জীবনের আবেগ বেশি প্রকাশ করেননি। একটি ব্যতিক্রমী ব্যক্তিগত প্ৰসঙ্গ উদ্ধৃতিযোগ্য: “একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাসু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাসু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তো তোমারও আব্বা।” কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল।(পৃ- ২০৯) পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে পুত্র শেখ কামাল (ইনিও ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সঙ্গেই নিহত হয়েছিলেন)তাঁর পরিবারের একুশজন সদস্যকে যেরকম র্নিমমভাবে হত্যা করা হয়,তাতে বিশ্ব নেতৃবৃন্ধ বঙ্গবন্ধু হত্যার নিন্দা ও বিশ্বের প্রায় সকল বাংলাভাষী মানুষই ব্যথিত ও আহত হয়েছিলেন।
 
শেখ কামাল: ক্ষণজন্মা প্রতিভার জন্মদিন আজ
 
আলোচনার বিষয় হিসেবে শেখ কামাল চমৎকার। তাঁর কত দিক, কত না বিচ্ছুরণ,কত বর্ণালী। ব্যক্তি, কবি, সংগঠক, নাট্যকার, নট, গীতিকার, গায়ক, বাদক,খেলোয়ার এত কিছু একসঙ্গে তিনি। বিশ্ব পর্যটক বা তাঁর মতো আর কে আছেন? আজকের ক্রীড়া, সাংকৃতি ও সাহিত্যের যত আধুনিকতা, যত পরীক্ষা- নিরীক্ষা তার জন্ম ওই শেখ কামালের জোব্বা থেকেই।
 
১৯৪৯ সালের ৫ আগস্টের এই দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল জন্মগ্রহণ করেন গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায়। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। সদ্য বিবাহিত যুবক। মৃত্যুর মাত্র এক মাস আগে (১৪ জুলাই ১৯৭৫) ক্রীড়াবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা ব্লু সুলতানা কামাল খুকুর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের মেহেদির রং তখনও মুছে যায়নি। এই ক্ষণজন্মা যুবক মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট কালরাতে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে জাতির পিতার হত্যাকারী মানবতার ঘৃণ্য শত্রুদের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে, যে- মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে-মাসেই ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে তিনি প্রথম শহিদ হন। বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ লালন করে দেশ-জাতিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন, তার গতিপথ রুদ্ধ করে দেওয়া হলো ১৯৭৫-এর হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। বনানীর কবরস্থানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
 
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ কামাল যদি তার নিজস্ব ভূমিকা রাখার সুযোগ পেতেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংবিধানে সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা আরও বেশি সহজ ও দ্রুততর হতো। আজ বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৭২ বছর।
 
পড়াশোনায় শেখ কামাল ছিলেন খুবই মেধাবী। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ঢাকার পল্টনের ডনস্কি ন্ডার গার্টেনে। এরপর ঢাকা শাহীন স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হন। এ বিভাগ থেকেই সাফল্যের সাথে ১৯৭৩ সালে অনার্স ও মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি সমাজবিজ্ঞানে এম.এ শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
 
 
উত্তরাধিকার সূত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নানা মানবিক ও নেতৃত্ব গুণাবলি পেয়েছিলেন শেখ কামাল। এর সঙ্গে শাণিত হয়েছিল সংস্কৃতিবোধ ও ক্রীড়া দর্শন। সংযুক্ত হয়েছিল দেশ ও মানুষের প্রতি অনুপম দরদ এবং দায়িত্ববোধ। খেলার মাঠ থেকে নাটকের মঞ্চ, সংগীতের ভুবন থেকে রাজনীতির ময়দান- সর্বত্র ছিল তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। ছিলেন বন্ধু ও সতীর্থদের মধ্যমণি। একই সময় সাংস্কৃতিক চর্চা আর খেলাধুলায় সমানভাবে জড়িত ছিলেন শেখ কামাল। খুব ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা ভালোবাসতেন। স্কুল ও কলেজ-জীবনেই সম্পৃক্ত হন খেলাধুলায়। কিন্তু হঠাৎ ছেদ পড়ে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গঠিত মুজিব বাহিনীর ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়েছেন এবং ট্রেনিং ক্যাম্পের বাছাই, তত্ত্বাবধান এবং সাংগঠনিক কাজে যুক্ত ছিলেন। ভারতে ট্রেনিং শেষে, শেখ কামালকে সংযুক্ত করা হয় মুক্তিবাহিনীর চিফ জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে। জেনারেল ওসমানীর সাথে তিনি যুদ্ধকালীন পুরো সময়টা ছিলেন। বিশ^স্ততা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন, ৯ মাসে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল নতুন এক সার্বভৌম দেশ- বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর তিনি সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন এবং পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান। সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসার কারণে তিনি আবার সংস্কৃতি, খেলাধুলা ও রাজনীতির মাধ্যমে দেশের মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। দেশের পতাকাকে ক্রীড়াঙ্গনের মাধ্যমে সারাবিশ্বে পরিচিত করার স্বপ্নই লালন করেছেন আজীবন।
 
শেখ কামালের নামে যত প্রোপাগান্ডা এবং তার জবাব
 
দেশ স্বাধীনের পর অন্য অনেক কিছুর মতো দেশের ক্রীড়াঙ্গনেও ছিল বেশ এলোমেলো অবস্থা। সে-সময় শেখ কামাল শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নয়, ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। বন্ধুদের নিয়ে ধানমন্ডির সাতমসজিদ এলাকায় ক্রিকেট, ফুটবলকে আধুনিকতার দিকে নিয়ে যেতে প্রতিষ্ঠা করেন আবাহনী ক্রীড়া চক্র ১৯৭২ সালে ইকবাল স্পোর্টিং ক্লাবের নাম পরিবর্তন করে আবাহনী ক্রীড়া চক্র নামকরণ করা হয়।
 
শেখ কামাল আধুনিকতার ছোঁয়ায় উজ্জ্বল করে তোলেন আবাহনীকে। সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে গোটা ক্রীড়াঙ্গনে। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি- এই খেলাগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন শেখ কামাল। সে-লক্ষ্যে ফুটবল, ক্রিকেটকে ঢেলে সাজাবার মাস্টারপ্ল্যান করেছিলেন শেখ কামাল। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফুটবল, হকি, ক্রিকেটারদের খুঁজে বের করে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তৈরি করেছিলেন নতুন দিনের জন্য, আপাত লক্ষ্য আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। স্বপ্ন কিন্তু এখানেই শেষ নয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আবাহনীর অভিযাত্রা সমৃদ্ধ হয়েছে তার অনন্য প্রজ্ঞা-মেধার মিশেল সম্মিলনে। সে-সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবাহনীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ক্লাবটিকে সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে নিতে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। তাতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল। আমাদের দেশের ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার মান উন্নয়নে শেখ কামাল অক্লান্ত শ্রম দিয়েছিলেন। ক্রীড়া জগতে তিনি রেখেছেন অপরিসীম অবদান। পাশাপাশি নতুন খেলোয়াড় তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলেছিলেন। শেখ কামালের অসাধারণ প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায় আজকের ফুটবল ক্লাব আবাহনীর ইতিহাস থেকেই। শেখ কামাল ক্রিকেট খেলেছেন আজাদ বয়েজ, আবাহনী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের হয়ে। ছিলেন ফুটবল-বাস্কেটবলের নিয়মিত সদস্য। আর সেখান থেকেই শেখ কামাল একপর্যায়ে দক্ষ সংগঠক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পায় বাংলাদেশের ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ বিভিন্ন খেলাধুলা। ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বাস্কেটবল টিমের অধিনায়কও। ফুটবল খেলায় তিনি শুধু বাংলাদেশ কেন, গোটা উপমহাদেশেই পশ্চিমা স্টাইলে বিপ্লব এনেছিলেন। সেই ১৯৭৩ সালে আবাহনীর জন্য বিদেশি কোচ বিল হার্ট-কে এনে ফুটবল- প্রেমিকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন! তখন ক্লাব তো দূরের কথা, এই উপমহাদেশে জাতীয় দলের কোনো বিদেশি কোচ ছিল না। ১৯৭৪ সালে আবাহনী যখন কলকাতার ঐতিহ্যবাহী আইএফএ শিল্ড টুর্নামেন্ট খেলতে যায়, তখন আবাহনীর বিদেশি কোচ আর পশ্চিমা বেশভূষা দেখে সেখানকার কর্মকর্তা আর সমর্থকদের প্রশংসা পায় এবং পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ খেলায় আবাহনী ক্রীড়া চক্র দর্শকের অবাক মুগ্ধতায় ভূয়শী প্রশংসা অর্জন করেছিল, মাটি কামড়ে ছোট ছোট পাসে মাঠজুড়ে চমৎকার ফুটবল খেলা উপহার দেওয়ার জন্য। শুধু আবাহনীই না, দলকানা দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, ইস্ট অ্যান্ড স্পোর্টিং ক্লাব, আবাহনীর পাশাপাশি এই ক্লাবগুলোতেও তখন ছিল তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাধান্য।
 
ক্রীড়াঙ্গনে সরব শেখ কামাল
 
শেখ কামাল শুধু খেলাধুলা নয়। স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মসূচির পাশাপাশি, সমাজ-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মনোনিবেশ করেছিলেন। সংগীতাঙ্গনে ছিল তার সরব উপস্থিতি। সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের ওস্তাদ খুরশিদ খানের নিকট থেকে সেতার বাজানোর ওপর প্রশিক্ষণ নেন। ভালো সেতার বাজাতেন তিনি। মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতেন, এছাড়া মৃদঙ্গ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচক্রের সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা কলেজে পড়ার সময় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পুরস্কার পান। বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন’ নামে একটি ব্যান্ডদল। এই গানের দলের মাধ্যমে তিনি পল্লীগীতি আর আধুনিক নানা সংগীতযন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় করে দেশের সংগীত জগতে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। তার হাত ধরে এদেশে পপসংগীতের সূচনা হয়েছিল। তার প্রতিষ্ঠিত ‘ স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর মধ্য দিয়েই ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদদের মতো জনপ্রিয় পপসংগীত শিল্পীরা এসেছেন।
 
 
মোট কথা সম্পূর্ণভাবে একজন সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিত্ব ছিলেন শেখ কামাল। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি জান্তা সরকার রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করল ধর্মীয় উগ্রতার পরিচয় দিয়ে। তার প্রতিবাদে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে অন্যদের সাথে অসহিংস প্রতিবাদের অসাধারণ উদাহরণ রাখলেন তিনি। শেখ কামাল ছিলেন বাংলাদেশের নাট্য-আন্দোলনের পুরোধা,ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।‘নাট্যচক্র’ নামে একটি নাটকের সংগঠন গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই নাট্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন শেখ কামাল। এই নাট্য সংগঠনের অভিনয়শিল্পী হয়েই নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদারের সঙ্গে কলকাতায় মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে গিয়েছিলেন তিনি। নাটক শেষে ফেরদৌসী মজুমদার ও শেখ কামালের অটোগ্রাফ নিতে সেদিন দর্শকরা ভিড় করেছিল।
 
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন নিবেদিত, সংগ্রামী, আদর্শবাদী কর্মী ও সংগঠক হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ছেষট্টির স্বাধিকার আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে। সে আন্দোলনে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন অর্জনে ও নির্বাচনে জয়লাভে পুরান ঢাকায় তিনি অবদান রাখেন। মাত্র ২৬ বছরের ছোট জীবনে তিনি নিজেকে উজ্জ্বল উদীয়মান নক্ষত্র হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। একজন ছাত্র-সংগঠক হিসেবে তিনি কখনও নেতৃত্বের শীর্ষে আসতে চাননি। তিনিই ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতেন, প্রেরণা জোগাতেন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ছাত্র-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা, পরবর্তীতে জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা।
 
মাত্র ২৬ বছরের জীবনে তিনি বেশ কিছু দেশ ভ্রমণ করেন। তার মধ্যে যুক্তরাজ্য (লন্ডন), রাশিয়া (মস্কো), জার্মানি (মিউনিখ ও বার্লিন), সুইজারল্যান্ড (জেনেভা), ভারত (কলকাতা, শিলিগুড়ি, ডুয়ার্স, মূর্তিসহ) অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
 
শেখ কামাল তীক্ষ্ণ,বুদ্ধিমান, দূরদর্শী, জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।শেখ কামাল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং বেঁচে থাকলে তিনি জাতিকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে পৃথিবীর শিখরে দাঁড় করিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মাথা উঁচু করে দেন।দেশকে চতুর্মুখী বিকাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান।স্বীয় ঔজ্জ্বল্যে সারাদেশে আলো ছড়িয়ে গেছেন।
 
নিজ প্রতিভা বলে দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শেখ কামাল জীবিত থাকলে দেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন আরও অনেক সমৃদ্ধ থাকত। ব্যক্তি শেখ কামালের মৃত্যু হলেও, তার কীর্তি-আদর্শ বেঁচে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে চিরদিন! ‘বাঙালি তরুণদের জন্য শেখ কামাল এখন রোল মডেল। ৪৬ বছর পরেও শেখ কামালকে কেউ কলঙ্কিত করতে পারেনি। তাই তরুণদের উচিত শেখ কামালের আদর্শ অনুসরণ করা। আজকে দেশে প্রমাণিত বঙ্গবন্ধু পরিবারই সৎ ও সাহসী রাজনীতির প্রতীক।তাকে হত্যার পর রাজনৈতিক কারণে বহু মিথ্যাচার করে নিন্দা ছড়ানো হয়েছে, যেগুলো পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।খুনিরা হয়তো তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে; কিন্তু তার অবদানকে মুছে দিতে পারেনি।
 
তাঁকে আঘাত করেছে স্পর্ধিত পরশ্রীকাতর সমালোচক, প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী, বঙ্গবন্ধু বিরোধী নব্য রাজাকাররাও । এত নিন্দেমন্দ ও অপমান সহ্য করে অটল থাকা এবং প্রত্যুত্তরে স্নেহার্দ্র ব্যবহার করা–এ কি বাঙালীর চরিত্র ? বহুবার বহুভাবেই তাঁকে ছোট করার চেষ্টা হয়েছে এবং এখনও হয় । কিন্তু এ যেন পর্বতকে স্থানচ্যুত করার চেষ্টা । শেখ কামাল নিন্দায় মুখরা, যৌবনের উন্মাদনা কেটে যাওয়ার পরই শেখ কামালের কাছে তারা নতজানু হয়েছেন। এ বারংবার দেখা গেছে। ক্রীড়া ও সাংকৃতি নিয়ে আমাদের যেটুকু বড়াই তার বারো আনা কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন শেখ কামাল । কিন্তু তাঁর তো কোনও দাবীদাওয়া ছিল না । রূপমুগ্ধ দুখানা চোখ দিয়ে তিনি কেবল এই ব্যক্তজীবনের সুধা পান করে গেলেন।
 
আজ তিনি বেঁচে থাকলে আমাদের ফুটবলের এ দুরাবস্থা হতো না, ক্রিকেটের মতো ফুটবলেও আমরা হতে পারতাম পৃথিবী সেরা। শুধু ক্রীড়াক্ষেত্র নয়, শিল্প-সংস্কৃতির প্রত্যেকটা ধারায় আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দিতে পারতাম সামনে থেকে। তাই শেখ কামাল আমাদের নান্দনিক ক্রীড়া সংস্কৃতিক এবং মূল সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব। শেখ কামাল আমাদের মননে স্মৃরিত। সেই স্মরণের আনন্দিত পুণ্যাহ ৫ ই আগস্ট দিনটি এক দায়বদ্ধতাও জাগায়। ক্রীড়াঙ্গন ,রাজনীতি এবং সংগীতের জন্য তার দানকে, তার সৃষ্টিকে পূর্ণ প্রাণে গ্রহণ এবং সমর্যাদায় সংরক্ষণের যোগ্য উত্তরাধিকার অর্জন করতে পেরেছি কি আমরা?ভাবনাটা আজ শঙ্কিত করে তুলেছে শেখ কামাল অনুরাগীদের।শেখ কামালের মৃত্যুতে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁর জায়গা তো কেউই পূর্ণ করতে পারলেন না, ঘটনাতা সত্যিই দুঃখজনক, কোন ক্রিড়াসংগঠন সে ভাবে দাঁড়াতে পারছেন না।তার ৭২ তম জন্মদিনে স্মরণ করছি, আমরা বিগত দিনের পথের সঞ্চয়ই আজ হয়ে উঠুক আমাদের পাথেয়। সেই হোক তাঁর অকৃপণ আশীর্বাদ।
 
 
আবাহনী ক্লাব চত্ত্বরে শহীদ শেখ কামাল এর স্মৃতিস্তম্ভে আমরা ক’জন মুজিব সেনার শ্রদ্ধার্ঘ্য । ০৫ আগস্ট ২০২১।
 
শেখ কামাল প্রমাণ করেছেন যে-বীর, সে জীবনের সমস্ত পর্যায়েই বীর।এই বীরত্ব,সম্মুখ যুদ্ধের বীরত্বের চেয়ে সহজতো নয়ই, বরং আরো কঠিন, ২৬ বছরের যুবক জীবনের যে কোন দুর্যোগেরগ্রস্তের কাছে,সর্বাথেই এক সংগ্রামের-প্রতীক।সমস্ত অন্ধকারের মধ্যে এক মশাল বহনকারী। শেখ কামাল তো সাধারণ একজন থেকে গেছেন, ক্ষমতা তাকে স্পর্শ করেনি। একটু বদলাতে পারেনি ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই ক্ষয় নাই’শেখ কামাল সবকিছু উৎসর্গ করে গেছেন দেশের জন্য।শেখ কামালের আত্মত্যাগের কথা আজকের প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা, শেখ কামালের ৭২ তম জন্মদিন উপযুক্ত মর্যাদার সঙ্গে পালন করতে হবে। সততা ও নৈতিক মূল্যবোধের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ছিলেন শেখ কামাল। কথায় ও কাজে দেশ প্রেমিকের মত তার উদাত্ত আহ্বানে সকল সংগঠন ও ক্রীড়াঙ্গকে উদ্বুদ্ধ ও একতাবদ্ধ করেছে।তিনি সারাদেশের যুবক খেলোয়ার,শিল্পি,রাজনৈতিক কর্মীদের হৃদয় স্পর্শ করেছেন এবং কর্মে উদ্যোগী করেছেন।৭২তম জন্মদিনে আজ আবার মনে পরে গেল কবি কামিনী রায়ের সেই বিখ্যাত কবিতা থেকে ‘পরের কারনে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন মন সকলই দাও, তার মতো সুখ কোথাও কি আছে আপনার কথা ভুলিয়া যাও’।আজ দেশের জন্য দরকার শুধু নি:শঙ্ক-নির্ভীক,একজন শেখ কামাল।তাঁর এই সুনির্দিষ্ট সময়টুকু ইতিহাসের পাতায় যাতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতই ভাস্বর হয়ে থাকে।
 
 পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই। নতুন যুগের প্রজন্ম শেখ কামালকে দেখেনি । তাঁর কৃতিত্ব ততটা সকলের পরিচিত নয়, যতটা তাঁর নিন্দা শুনতে পেরেছে । শেখ কামালের বিচরণক্ষেত্র ছিল বিশাল। কবিতা, সংগীত, নাটক, গীতি-নাট্য, নৃত্য-নাট্য, চিত্রকলা, বিজ্ঞান শিক্ষা, সংগঠক মননশীলতার নদীটি বহে চলে গেছে ক্রীড়া, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপত্যকার প্রতিটি বিভাগকে সঞ্জীবিত করে। একালের শ্রেষ্ঠ মেধা বসেছেন বিচারে । শেখ কামালের -প্রভা ম্লান, না অম্লান ! বিচারের সূক্ষ্মতম মান নির্ধারক যন্ত্রও নির্দ্বিধায় বলে আমরা শুধু মনেই রাখিনি, কাল থেকে কালান্তরে শ্রুত হবে শেখ কামালের কল্লোল । বাইরে অক্লান্ত কর্মরত থেকেও অন্তরে তিনি চিরদিন ছিলেন ভাবের সাধনায় মগ্ন। তাঁর জীবন কর্ম-ভক্তি- জ্ঞানযোগের এক অপূর্ব নিদর্শন। একাধারে অনন্য সৃষ্টিকার ও ত্যাগী জীবনের এমন অপরূপ সমন্বয় এই বাংলার মাটিতেই সম্ভব হয়েছে। কারণ, তিনি বাঙালির যা কিছু সত্য, যা কিছু নিত্য তার মূর্ত প্রতীক।
 
বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ কামাল এর জন্মদিন উপলক্ষে আমরা ক’জন মুজিব সেনা কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ০৫ আগস্ট দুপুর ২ টায় ধানমণ্ডি ১০ নং সড়কে পানশি রেস্তোরাঁ’র সম্মুখে শহীদ শেখ কামাল এর স্মরণে দোয়া ও দুঃস্থদের মাঝে খাদ্য বিতরণ কর্মসুচি আয়োজন করে।
 
 
শেখ কামালকে বাঙালি দেখবে তার হৃদয়ের ছবিথেকে, তার আত্মার বাণীরূপে। শেখ কামালের জন্মদিনে সকল সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলে সম্মিলিতভাবে এই দিনটিকে পালন করে সাম্প্রদায়িক প্রীতি স্থাপনে উদ্যোগী হই।
 
সাইদ আহমেদ বাবু : সভাপতি,আমরা ক’জন মুজিব সেনা ও সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK